জি ২৪ ঘণ্টা ডিজিটাল ব্যুরো: চলতি বছরে দুর্নীতির অভিযোগে এসএসসি'র ২০১৬ সালের পুরো প্যানেল বাতিল হয়েছে ৷ চাকরিহারা হয়েছে একসঙ্গে তিরিশ হাজারের বেশি শিক্ষক। এবার বুধবার প্রাথমিকে ৩২ হাজার শিক্ষকের নিয়োগ নিয়ে রায় ঘোষণা করল কলকাতা হাইকোর্ট ৷ এই নিয়োগেও ব্যাপক বেনিয়মের অভিযোগ তুলে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন মামলাকারীরা ৷ দীর্ঘ ২ বছরেরও কিছু বেশি সময় ধরে এই মামলার শুনানি হয়েছে ৷ কেন এই অভিযোগ এবং মামলাকারীদের যুক্তি কী? রইল সওয়াল-জবাব ৷
২০২৩ সালের ১২ মে কলকাতা হাইকোর্টের তৎকালীন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় মোট ৩৬ হাজার কর্তব্যরত প্রাথমিক শিক্ষককে চাকরি থেকে বরখাস্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন ৷ পরে তা কমে ৩২ হাজার হয় ৷ ২০১৪ সালের টেট পরীক্ষার ভিত্তিতে ২০১৬ সালে প্রায় ৪২ হাজার ৯৪২ জন শিক্ষক নিয়োগ করেছিল প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ ৷ এদিকে নিয়োগে একাধিক ত্রুটি রয়েছে দাবি করে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন প্রিয়ঙ্কা নস্কর নামে এক প্রার্থী-সহ প্রায় ১৪০ জন ৷
দুর্নীতির অভিযোগ
মামলাকারীদের অভিযোগ, এই শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়ম মেনে অ্যাপটিটিউড টেস্ট নেওয়া হয়নি ৷ প্রশিক্ষণ ছাড়াই প্রার্থীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে ৷ সংরক্ষণের তালিকা মেনে শিক্ষক নিয়োগ হয়নি ৷ বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে ওই বছর ১৫ মে কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে আবেদন জানায় প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ ৷ বিচারপতি সুব্রত তালুকদার ও বিচারপতি সুপ্রতীম ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চ এই চাকরি বাতিলে স্থগিতাদেশ দেয় ৷ পরে মামলা সুপ্রিম কোর্ট ঘুরে ফের কলকাতা হাইকোর্টে আসে ৷ শীর্ষ আদালত কলকাতা হাইকোর্টকেই এই মামলার নিষ্পত্তি করতে নির্দেশ দেয় ৷ এরপর একাধিক বেঞ্চ ঘুরে মামলা আসে বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী ও বিচারপতি ঋতব্রত কুমার মিত্রের ডিভিশন বেঞ্চে ৷
দুই পক্ষের শুনানিতে যুক্তি পালটা যুক্তি
মামলাকারীদের যুক্তি
আইনজীবী বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য আদালতে সওয়াল করেন, 'এটা একটি প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি ৷ এস বসু রায় অ্যান্ড কোম্পানিকে ওএমআর শিট তৈরি করা, মূল্যায়ন করা, চূড়ান্ত প্যানেল তৈরি করা-সহ একাধিক কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ৷ পাশাপাশি নিয়োগের জন্য সিলেকশন কমিটি তৈরি করা হয়েছিল কোন রুলে? রাজ্যের অনুমতি নেওয়া হয়েছিল কি না, তার কোনও নথি প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ দেখাতে পারেনি ৷'
নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি থেকে দেখা যাচ্ছে ২০১৬ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর এই বিজ্ঞপ্তিতে প্রশিক্ষণহীনদের কোনও ছাড় দেওয়া হয়নি ৷ এদিকে কেন্দ্রীয় মানব সম্পদ উন্নয়ন নির্দেশ দিয়েছিল, ৩১ মার্চ পর্যন্ত প্রশিক্ষণহীনদের চাকরি দেওয়া যাবে ৷ কিন্তু রাজ্যের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয় সেপ্টেম্বরে ৷ তাহলে যাঁরা প্রশিক্ষণ ছাড়া নিয়োগ পেয়েছিলেন, তাঁদের নিয়োগ যথাযথ নয় ৷ এক্ষেত্রে রাজ্য যুক্তি দেয়, তারা আইন সংশোধন করেছিল ৷ কিন্তু যখন বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছিল তখন এই ছাড়ের নির্দেশ ছিল না ৷ ফলে যাঁদের প্রশিক্ষণ ছাড়া সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তাঁদের টাকার বিনিময়েই সুযোগ দেওয়া হয়েছে ৷
নিয়ম অনুয়ায়ী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের ডিপিএসসি'র (জেলার প্রাথমিক স্কুল কাউন্সিল)-এর চেয়ারম্যান থাকতে হবে ৷ কিন্তু জেলার ডিপিএসসি নিয়ম মেনে গঠিত হয়নি ৷ বোর্ড সিলেকশন কমিটি তৈরি করেছিল দু'বছরের জন্য ৷ অথচ যখন অ্যাপটিটিউড টেস্ট নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ ওঠে, তখন বোর্ড নিজেই বলেছে জেলাভিত্তিক নিয়োগে মেধা যাচাই করা হয়েছিল ৷ তাহলে প্রত্যেক জেলার যে কাউন্সিল ছিল, তাদের কি আদৌ কোনও ভূমিকা ছিল ? নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতি করার জন্যই রুল বাইপাস করে এতকিছু করা হয়েছে, অভিযোগ বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্যের ৷
মামলাকারী পক্ষের আরেক আইনজীবী সৌম্য মজুমদার বলেন, '৩২ হাজারের চাকরি বাতিল নাও হতে পারে ৷ কিন্তু ৪২ হাজার প্যানেল পুনর্গঠন করা হোক ৷'
বিচারপতি প্রশ্ন করেন, কী ভাবে তা সম্ভব ?
এর উত্তরে আইনজীবী জানান, 'অ্যাপটিটিউড টেস্টের জন্য 5 নম্বর ৷ এই নম্বরই তো বিরাট তফাৎ করে দিতে পারে ৷ যাঁরা প্রশিক্ষিত তাঁদের কিছু হবে না ৷ কিন্তু যাঁদের প্রশিক্ষণ ছিল না, তাঁদের ক্ষেত্রে এই নম্বর পার্থক্য তৈরি করে দেবে ৷ তাই হয় সবাইকে ৫ নম্বর দেওয়া হোক ৷ অথবা সবার পাঁচ নম্বর বাদ দেওয়া হোক ৷'
রাজ্য ও প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের যুক্তি
নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কিছু ভুল-ত্রুটি থাকা আর দুর্নীতি এক জিনিস নয় ৷ মামলাকারীরা বার বার ২০১৬ সালের প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়াতে দুর্নীতির যে অভিযোগ তুলেছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা, শুনানিতে দাবি করেন রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল কিশোর দত্ত ৷ তিনি এই অভিযোগকে 'কাল্পনিক' বলেও উল্লেখ করেন ৷
প্রায় ৪৩ হাজার নিযুক্ত শিক্ষকের মধ্যে মোট ৯ জন প্রার্থী যাঁরা টেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হননি, আদালতের নির্দেশ মতো তাঁদের চাকরি বাতিল করেছিল প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ ৷ সেই নির্দেশকে হাতিয়ার করে দুর্নীতির অভিযোগ করা হচ্ছে বলে জানান রাজ্যের এজি ৷ এর সঙ্গে ৩২ হাজার কর্মরত শিক্ষকের কোনও যোগ নেই ৷ অ্যাডভোকেট জেনারেলের আরও যুক্তি, 'এত দুর্নীতি করা হল, এদিকে সিবিআই তদন্তে দেখা যাচ্ছে দুর্নীতির অভিযোগে তদন্তে তারা মাত্র ৩৬০ জনকে খুঁজে পেয়েছেন, যাঁদের প্রশিক্ষণ নেই ৷'
মোট ৪৩ হাজার নিয়োগের মধ্যে ৩২ হাজার প্রশিক্ষণহীন ছিল ৷ এরা চাকরি পাওয়ার পর প্রশিক্ষণ নিয়েছে ৷ আর 11 হাজারের কাছাকাছির নিয়োগের সময়ই প্রশিক্ষণ ছিল ৷
এস বসু রায় অ্যান্ড কোম্পানি যাদের দিয়ে বোর্ড নিয়োগের সমস্ত কাজ করিয়েছিল বলে বার বার অভিযোগ করা হচ্ছে, ওএমআর শিট বানানোর কাজ তারা করেছিল ঠিকই । কিন্তু তাতে নম্বর দেওয়া থেকে অন্য কাজ করেছিল বোর্ড ৷ তাদের কাজটা ছিল মূলত ছাপাখানার কাজ ৷
প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ ইন্টারভিউ, ওএমআর স্ক্রুটিনি করার জন্য একাধিক সাব কমিটি তৈরি করেছিল ৷ এস বসু রায় অ্যান্ড কোম্পানির এখানে কোনও ভূমিকাই ছিল না ৷
এস বসু রায় কোম্পানির মেধাতালিকা প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে কোনও ভূমিকা ছিল না ৷ ২০১৮ সালে ১ মে ও ১৫ মে আদালতের নির্দেশে কয়েকজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্তকে চাকরিতে নিয়োগ করা হয়েছিল ৷ সেই নিয়োগ বেআইনি বলে ভুল বোঝানোর জন্য আদালতে মিথ্যা তথ্য দিয়েছে মামলাকারীরা ৷ প্রত্যেক জেলা কাউন্সিলের অফিসে প্যানেল প্রকাশ করা হয়েছিল ৷
২৮ এপ্রিল শুরু হয়েছিল এই মামলার শুনানি ৷ গত ১২ নভেম্বর মামলার শুনানি শেষে রায়দান স্থগিত রাখে আদালত ৷ আজ সেই মামলার রায় ঘোষণা হতে চলেছে ৷