নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্নের মুখে প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়
দৈনিক স্টেটসম্যান | ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫
প্রাথমিকে নিয়োগ সংক্রান্ত মামলায় বুধবার বহু প্রতীক্ষিত রায় ঘোষণা করল কলকাতা হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ। সিঙ্গল বেঞ্চের প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশে যে ৩২ হাজার শিক্ষকের চাকরি বাতিল হয়েছিল, সেই রায় সম্পূর্ণ খারিজ করে দিল ডিভিশন বেঞ্চ। ফলে দীর্ঘ টানাপোড়েন ও অনিশ্চয়তার শেষে ওই ৩২ হাজার শিক্ষকের চাকরি শেষ পর্যন্ত বহাল থাকছে। বিষয়টি নিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে নতুন করে বিতর্ক দানা বেঁধেছে। কারণ সিঙ্গল বেঞ্চের প্রাক্তন সেই বিচারপতি এখন কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপির একজন সাংসদ। সেই সময় এই রায়ে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূলের পক্ষ থেকে বিচারপতির নিরপেক্ষতা নিয়ে যে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিল, রাজনৈতিক মহলে তা যেন নতুন করে মান্যতা পেতে শুরু করল।
এই মামলায় ডিভিশন বেঞ্চ স্পষ্ট জানিয়েছে, প্রাথমিকের নিয়োগ নিয়ে যে তদন্ত চলছে, তা অব্যাহত থাকবে। তবে প্রায় এক দশক পরে একযোগে এত শিক্ষকের চাকরি কেড়ে নেওয়া হলে রাজ্যের স্কুলগুলির শিক্ষাব্যবস্থা পুরো ভেঙে পড়বে। পাশাপাশি বহু পরিবার চরম আর্থিক সঙ্কটে পড়বে। আদালতের পর্যবেক্ষণ, যাঁরা এতদিন কোনও অভিযোগ ছাড়াই শিক্ষক হিসাবে কাজ করে গিয়েছেন, তাঁদের জীবিকা হঠাৎ করে কেড়ে নেওয়া সঙ্গত নয়।
হাইকোর্ট আরও জানিয়েছে, দুর্নীতি বা অনিয়ম যদি কারও বিরুদ্ধে প্রমাণিত হয়, তবে তাঁদের বিরুদ্ধে পৃথকভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করে সৎদের ‘দুর্নীতির তকমা’ পরানো যায় না। আদালতের মন্তব্য, পরীক্ষক বা পর্ষদকে অতিরিক্ত নম্বর দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল— এমন কোনও প্রমাণ নজরে আসেনি। কয়েকজন অসন্তুষ্ট বা অকৃতকার্য প্রার্থীর অভিযোগের ভিত্তিতে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াকে অবৈধ বলে গণ্য করা যায় না।
প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের বিজ্ঞপ্তির ভিত্তিতে প্রাথমিকে দুই দফায় নিয়োগ হয়েছিল। প্রথমে ৪২,৯৪৯ জন এবং পরে আরও ১৬,৫০০ জন প্রার্থী চাকরি পান। মামলাকারীদের দাবি ছিল, মেধাতালিকা বানানো থেকে ইন্টারভিউ নম্বর, সবেতেই ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। অন্যদিকে পর্ষদ দাবি জানিয়েছিল, বিচ্ছিন্ন কিছু অনিয়ম ধরা পড়লেও তা সংশোধন করা হয়েছিল। পুরো প্রক্রিয়ায় কোনও দুর্নীতি লক্ষ্য করা যায়নি।
এই রায় ঘোষণার পর প্রাক্তন বিচারপতি ও বর্তমান বিজেপি সাংসদ অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে বহু দিক থেকে প্রশ্ন করা হয়। বর্তমানে দিল্লিতে সংসদীয় অধিবেশনে ব্যস্ত থাকায় তিনি এখন কলকাতায় নেই। তাঁর বক্তব্য, ডিভিশন বেঞ্চ যা সঠিক মনে করেছে, তাই রায় করেছে। তিনি এখন মতামত দেওয়ার অধিকারী নন। যদিও আগেই বলেছিলেন, তিনি ‘দুর্নীতিগ্রস্ত সিস্টেমকে বিসর্জন দিতে’ চেয়েছিলেন।
বিপরীতে তৃণমূলের একাধিক নেতা অভিযোগ তুলেছেন, অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বিচারকের আসনে বসে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই চাকরি বাতিলের রায় দিয়েছিলেন। তাঁদের দাবি, ডিভিশন বেঞ্চের রায় সেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকেই সামনে এনে দিয়েছে।
রায়ের ফলে এখন স্পষ্ট— দুর্নীতির তদন্ত চলবে, কিন্তু সমষ্টিগত শাস্তিতে নয়, ব্যক্তিগত দায়েই হবে ব্যবস্থা। আদালত মনে করেছে, হঠাৎ করে ৩২ হাজার শিক্ষককে সরিয়ে দিলে রাজ্যের স্কুলগুলিতে শিক্ষক সঙ্কট তৈরি হবে। ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষার ক্ষতি হবে এবং বহু পরিবারের রুটিরুজি বন্ধ হয়ে হবে।
এ দিনের রায় স্পষ্ট করে দিল, শিক্ষা ব্যবস্থার স্থিতি ও শিক্ষক-পরিবারের জীবিকার কথা মাথায় রেখেই আদালত ভারসাম্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।