হাঁপ ছাড়ল ৩২ হাজার পরিবার! জেলায় জেলায় আবিরখেলা, হাই কোর্ট চত্বরেও উল্লাসে মাতলেন প্রাথমিক শিক্ষকেরা
আনন্দবাজার | ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫
চাকরি বহাল থাকছে। কলকাতা হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ এই রায় দেওয়ার পরেই হাঁপ ছেড়ে বাঁচল ৩২ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকের পরিবার। উল্লাস আর উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়লেন শিক্ষকেরা। তাঁদের মধ্যে অনেকে আবার আগের রায় নিয়ে ক্ষোভ উগরে দিয়ে দাবি করেছেন, সিঙ্গল বেঞ্চের রায় যে ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ ছিল তা এই রায়ে প্রমাণিত হল। সত্যের উদ্ঘাটন হল। সত্যের জয় হল। ডিভিশন বেঞ্চের রায় বেরোনোর পরেই জেলায় জেলায় বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস ধরা পড়ল। কোথাও কোথাও আবার আবিরখেলায় মাতেন শিক্ষকেরা। কোথাও আবার মিষ্টি বিতরণও হল।
বুধবার সকাল থেকেই এই মামলার দিকে নজর ছিল গোটা রাজ্যের। বিশেষ করে ৩২ হাজার শিক্ষকের, যাঁদের নিয়োগ বাতিল ঘোষণা করা হয়েছিল ২০২৩ সালে। সকাল থেকেই আদালতের বাইরে ভিড় জমাতে থাকেন শিক্ষকেরা। তাঁদের চোখেমুখে উৎকণ্ঠার ছাপ ধরা পড়েছিল। কিন্তু অনেকে আবার আশাবাদীও ছিলেন যে, তাঁদের জয় হবেই। আর হলও তা-ই। দীর্ঘ দু’বছর ধরে যে লড়াই তাঁরা চালিয়ে গিয়েছেন, সেই লড়াইয়ে জয় পেতেই উচ্ছ্বাস আর আনন্দে ভাসলেন তাঁরা। আদালত চত্বরে কারও মুখে হাসি ধরা পড়ল। কেউ আবার আবেগতাড়িত হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
এক শিক্ষকের কথায়, ‘‘আজকে মনে হচ্ছে যেন প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে পারছি। গত দু’বছর ধরে যে অপমান, লাঞ্ছনা এবং মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে। এই রায়ের পর এক নিমেষে সব উধাও হয়ে গিয়েছে।’’ অন্য এক শিক্ষক আবার বলেছেন, ‘‘আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল এই লড়াইয়ে যখন নেমেছি, জয় আমাদের হবেই। আজ সত্যের জয় হল। আমরা জিতলাম। আমাদের লড়াই জিতল।’’
অন্য এক শিক্ষক বলেন, ‘‘ ৩২ হাজার চাকরি বাতিল ঘোষণা পর দানবীয় উল্লাস দেখেছিলাম। আজ তাঁদের যোগ্য জবাব দিয়েছি। বাসে, ট্রেনে উপহাস করা হয়েছে। শুনতে হয়েছে ২৬ হাজার গেছে, ৩২ হাজার যাবে। কিন্তু হাই কোর্টের এই রায় আবার প্রমাণ করল সত্যের জয় হয়।’’
২০২৩ সালে ৩২ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি বাতিলের রায় দিয়েছিল হাই কোর্টের তৎকালীন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের সিঙ্গল বেঞ্চ। তার পর থেকে নিজেদের প্রমাণ করতে মরিয়া লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন এই শিক্ষকেরা। নাওয়া-খাওয়া ভুলে আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছেন। তাই সেই শিক্ষকেরা আজ এই লড়াইয়ের ফসল তুলে নিয়ে যাচ্ছেন নিজেদের ঘরে। পরিবারের সামনে গিয়ে আজ মাথা তুলে দাঁড়াবেন। অনেকে বলছেন, যে ভাবে এত দিন ধরে রাস্তাঘাটে, আত্মীয়স্বজনদের কাছে এবং পরিচিতদের কাছে উপহাসের পাত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, হাই কোর্টের এই রায় তার যোগ্য জবাব দিল।
শিলিগুড়ির বাঘাযতীন পার্ক ময়দানে আবির খেলে এই রায়কে উৎসবের মেজাজে পালন করেন প্রাথমিক শিক্ষক-শিক্ষিকারা। শিক্ষক অভিজিৎ বিশ্বাস বলেন, ‘‘আদালতের উপর আমাদের ভরসা ছিল। বিচারব্যবস্থা আমাদের কথা শুনবে এই বিশ্বাস আমাদের সব সময় ছিল। সর্বোপরি আমাদের নিজেদের উপর বিশ্বাস ছিল। আমরা অবশ্যই খুশি।’’
শিক্ষিকা মৌমিতা চট্টোপাধ্যায় বলেন , ‘‘রায় নিয়ে আমরা বিশ্বাসী ছিলাম যে, আমরাই জিতব। আমাদের নিজস্ব আইনজীবী ও পর্ষদের আইনজীবীরা যেভাবে লড়াইটা করেছে সেখানে ১০০ শতাংশ আমাদের বিশ্বাস ছিল আমরাই জিতব এবং সেটাই হয়েছে।’’ শিক্ষিকা সোমালিকা দাস বলেন , ‘‘আড়াই বছর পর আমরা মুক্তির শ্বাস নিতে পারছি। এটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যাঁরা পাশে থেকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ করে দিয়েছিলেন তাঁদের সকলকে অসংখ্য ধন্যবাদ।’’
কোচবিহার ২ নম্বর ব্লক মধুপুর মাটিকাটা সিএস প্রাথমিক বিদ্যালয়) , সবাই তো দুর্নীতিগ্রস্ত নয়। যাঁরা পড়াশোনা করে চাকরি পেল ন’বছর চাকরি করার পর হঠাৎ করে চাকরিহারা হয়ে গেল। এই ক’টা দিন তাঁদের কী ভাবে কেটেছে, শুধু তাঁরাই উপলব্ধি করতে পেরেছেন। ৩২ হাজার লোকের হয়ে মহামান্য আদালত আজ যে রায় দিয়েছে সেটা একটি মানবিক রায়।’’ মোয়ামারী এইডেট প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক সঞ্জীব চক্রবর্তী বলেন, ‘‘দু’বছর সাত মাস আমরা যে কলঙ্ক লিপ্ত অবস্থায় ছিলাম সেই কলঙ্ক আজ ঘুচে গেল।’’
পশ্চিম বর্ধমান জেলার আসানসোলের শিক্ষক উদয়ভান চৌবে বলেন, ‘‘সত্যমেব জয়তে। আমাদের আস্থা ছিল আদালতের প্রতি, আজকের এই রায় প্রমাণ করল কোনও দুর্নীতি হয়নি। আদালত সমস্ত দিক বিবেচনা করে এই রায় দিয়েছে। এই রায়দানে অত্যন্ত খুশি আমরা।’’
বুধবার কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী এবং বিচারপতি ঋতব্রতকুমার মিত্রের ডিভিশন বেঞ্চ ৩২ হাজার চাকরি বাতিল মামলা রায় দেয়। বিচারপতিদের পর্যবেক্ষণ, ‘‘এত দিন চাকরি করেছেন ৩২ হাজার শিক্ষক। তাঁদের পরিবারের কথা ভেবে আদালত চাকরি বাতিল করছে না।’’ এর আগে স্কুল সার্ভিস কমিশনে দুর্নীতির অভিযোগে ২৬ হাজার চাকরি বাতিল করে দিয়েছিল কলকাতা হাই কোর্ট। সুপ্রিম কোর্টেও সেই নির্দেশ বহাল থাকে। ২০১৬ সালের এসএসসি প্যানেল বাতিল করে শীর্ষ আদালত জানায়, নতুন করে নিয়োগপ্রক্রিয়া শুরু করতে হবে কমিশনকে। সেই অনুযায়ী নতুন নিয়োগপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তবে প্রাথমিকের ক্ষেত্রে তা হল না। হাই কোর্টের বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী এবং বিচারপতি ঋতব্রতকুমার মিত্রের ডিভিশন বেঞ্চ দুর্নীতির অভিযোগ মেনে নিয়েও জানাল, শিক্ষকদের পরিবারের কথা ভেবে চাকরি বহাল রাখা হল।