এই সময়: ভোটার তালিকা থেকে ভূত তাড়াতে সব জেলাশাসক তথা জেলা নির্বাচনী আধিকারিকদের (ডিইও) সাত দফা প্রেসক্রিপশন দিয়েছিলেন রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক (সিইও)। সেই ছাঁকনিতে প্রথমেই উঠে এল রাজ্যের একাধিক বিধানসভা কেন্দ্রে দাখিল হওয়া এনিউমারেশন ফর্মে ‘প্রোজেনি ম্যাপিং’–এর অস্বাভাবিক হার। এনিউমারেশন ফর্ম ফিলআপের সময়ে যাঁরা ২০০২–এর ভোটার লিস্টের সঙ্গে নিজের বা নিজের বাবা–মার লিঙ্কেজ দেখাতে পারেননি, তাঁদের ঠাকুরদা–ঠাকুমা বা দাদু–দিদার লিঙ্কেজ দেখানোর সুযোগ দিয়েছিল দেশের নির্বাচন কমিশন (ইসি)। একেই বলা হচ্ছে ‘প্রোজেনি ম্যাপিং’। কিন্তু যে সব বুথে প্রোজেনি ম্যাপিংয়ের হার ৫০ শতাংশ বা তার বেশি, অর্থাৎ কোনও বুথের ৫০ শতাংশ বা তার বেশি সংখ্যক ভোটার নিজের বা বাবা–মার লিঙ্কেজ দেখাতে পারেননি, সেই বুথগুলিতে বাড়তি নজরদারির নির্দেশ দিয়েছিলেন সিইও মনোজ আগরওয়াল। সেই তালিকা ঝাড়াইবাছাই করতে গিয়েই কমিশনের নজরে উঠে এসেছে চমকপ্রদ তথ্য। দেখা যাচ্ছে, রাজ্যের সীমান্তবর্তী অনেক জেলাতেই এই প্রোজেনি ম্যাপিংয়ের হার বেশ কয়েকটি বুথে ৫০ শতাংশের বেশি।
বুধবার কমিশন সূত্রের খবর, প্রাথমিক ভাবে রাজ্যের ৩০ বিধানসভা কেন্দ্রের ৩০টি বুথকে প্রোজেনি ম্যাপিংয়ের অস্বাভাবিক হারের নিরিখে আলাদা করে চিহ্নিত করা হয়েছে। যেখানে এক একটি বুথে ৯৫ শতাংশ বা তারও বেশি এনিউমারেশন ফর্মে ভোটার ‘প্রোজেনি ম্যাপিং’ করেছেন। এই তালিকায় রয়েছে রাজ্যের সীমান্তবর্তী ছ’টি জেলা কোচবিহার, উত্তর দিনাজপুর, মুর্শিদাবাদ, মালদা, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা। সেখানে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত ৫০টি বিধানসভা কেন্দ্রে ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ এনিউমারেশেন ফর্মে প্রোজেনি ম্যাপিং করা হয়েছে।
কমিশন সূত্রের খবর, দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগর বিধানসভা কেন্দ্রের ৬ নম্বর বুথের ভোটার সংখ্যা ১,২৭৮। তাঁদের মধ্যে ১,১৯৯ জনই তাঁদের এনিউমারেশন ফর্মে নিজের বা বাবা–মায়ের লিঙ্কেজ দেখাতে পারেননি। সেখানে তাঁদের দাদু–দিদিমা বা ঠাকুরদা–ঠাকুমার লিঙ্কেজ দেখানো হয়েছে, যা কমিশনের নজরে আপাত ভাবে অস্বাভাবিক ঠেকেছে। কুলতলির ৮৫ নম্বর বুথে ১,১৫৪ জন ভোটারের মধ্যে ১,০০২ জন, উত্তর ২৪ পরগনার হিঙ্গলগঞ্জের ১৬২ নম্বর বুথের ৭৭৯ জন ভোটারের মধ্যে ৭০৫ জন একই ভাবে লিঙ্কেজ দেখিয়েছেন। উত্তর দিনাজপুরের হেমতাবাদের ৫৪ নম্বর বুথে ১,১১৯ ভোটারের মধ্যে ৯৭৭ জন, মালদার হবিবপুরের ৩০ নম্বর বুথে ৯১৮ জনের মধ্যে ৮৩৯ জন এনিউমারেশন ফর্মে ২০০২–এর ভোটার তালিকায় প্রোজেনি ম্যাপিং করেছেন। সীমান্তবর্তী বিধানসভা কেন্দ্র দিনহাটা, ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি, চোপড়া, হেমতাবাদ, সামশেরগঞ্জ, ফরাক্কা, সুজাপুর, সুতি, রঘুনাথগঞ্জ, বসিরহাট উত্তরের মতো একাধিক বিধানসভা কেন্দ্রও কমিশনের নজরে রয়েছে।
কমিশন সূত্রে জানা গিয়েছে, চোপড়া বিধানসভা কেন্দ্রের ৭৮,৩০০, ফরাক্কায় ৬৮,৭৩৬, সুতিতে ৮৩ হাজারের বেশি, রঘুনাথগঞ্জে ৭৯,৯২১, বসিরহাট উত্তরে ৯৫,৫৫৯ জন ভোটার এনিউমারেশন ফর্মে প্রোজেনি ম্যাপিং দেখিয়েছেন। এ ছাড়াও দক্ষিণবঙ্গের মেটিয়াবুরুজ, বীরভূমের মুরারইয়ের মতো একাধিক বিধানসভা কেন্দ্রেও উল্লেখযোগ্য হারে প্রোজেনি ম্যাপিংকে হাতিয়ার করে এনিউমারেশন ফর্মে লিঙ্ক করা হয়েছে।
এই চিত্র উঠে আসতেই প্রশ্ন উঠেছে, এরা কি আদতে ভারতীয় নাগরিক, নাকি অনুপ্রবেশকারী? না হলে কেন নিজের বা বাবা–মায়ের নামে লিঙ্কেজ দেখাতে পারেননি? নির্বাচন কমিশনের তরফ থেকে প্রত্যেক ইলেক্টোরাল রেজিস্ট্রেশন অফিসারকে (ইআরও) এই ধরনের প্রতিটি বুথ ধরে ধরে যাচাই করতে বলা হয়েছে। এর তালিকা জেলার পর্যবেক্ষকদের কাছে পাঠানো হয়েছে। কমিশন এটাও দেখেছে, বহু এনিউমারেশন ফর্ম পাওয়া গিয়েছে যেখানে স্বামী ও স্ত্রী দু’জনেরই বাবা-মায়ের নাম এক। এই ধরনের বুথগুলির তথ্যও কমিশনের লেন্সে রয়েছে। সূত্রের দাবি, বুধবার পর্যন্ত রাজ্যে ‘নিখোঁজ’ ভোটারের সংখ্যা ৫০ লক্ষ ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে মৃত ভোটার রয়েছেন ২৩ লক্ষ।