চুল টানছে ভূতে! ‘অশরীরী’র উৎপাতে অজ্ঞান ছাত্রী, পুরুলিয়ার স্কুলে বিজ্ঞান মঞ্চ
প্রতিদিন | ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫
সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: শৌচাগারে যেতেই ছাত্রীর লম্বা চুল টেনে দিয়েছিল কেউ। তাতে ব্যাপক ভয় পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ক্লাসরুমে এসেই অজ্ঞান হয়ে যায় ওই ছাত্রী। টানা ১ ঘন্টা ২০ মিনিট তার জ্ঞান ফেরেনি! হাসপাতালে সাতদিন ধরে চিকিৎসাধীন ছিল সে। সিটি স্ক্যান, ইইজি, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, হিমোগ্লোবিন সমস্ত রকম পরীক্ষা হয়ে যায়। কিন্তু রোগ খুঁজে পাওয়া যায়নি। হাসপাতাল ছুটি শেষে স্কুলে পা রাখতেই ছাত্রীকে কাউন্সেলিং করানো হয়। উঠে আসে ‘চুল টানা ভূতে’র গল্প! ব্যস, তারপরেই ভূতের ভয় পুরুলিয়া ১ নম্বর ব্লকের সোনাইজুড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। কীভাবে সেই আতঙ্ক কাটানো যায়, তা নিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের পরামর্শ চায়। বৃহস্পতিবার ওই সংগঠনের ৬ জনের একটি প্রতিনিধিদল ওই স্কুলে পা রেখে ভূতের বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করে।
বেগুনকোদরে ট্রেন ভূত, হুড়ার অর্জুনজোড়ায় বাইক ধরা ভূত, কাশিপুর ও নিতুড়িয়ার হোস্টেলে ভূতের গুজব তুলে ধরে পড়ুয়াদের কাছে বিজ্ঞান মঞ্চ জানায়, ভূতের ছবি তারা যদি কেউ ক্যামেরাবন্দি করতে পারে তাহলে ৫ লক্ষ টাকা পুরস্কার। ভূত ধরতে নানা মজার খেলা দেখিয়ে ওই পড়ুয়াদের বৃহস্পতিবার ভয় ভাঙার চেষ্টা করে বিজ্ঞান মঞ্চ। এদিন স্কুলে পড়ুয়াদের সঙ্গে ছিলেন অভিভাবকরাও। কিন্তু তাতে হবে কী? ভূত আতঙ্ক যে পিছু ছাড়ছে না ওই প্রাথমিক বিদ্যালয় পড়ুয়াদের। তবে স্কুল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আর কোনও আতঙ্ক নেই, সতর্ক করা হয়েছে সবাইকে।
ঘটনা গত নভেম্বরের ১২ তারিখের। স্কুল চলাকালীন শৌচাগারে গিয়েছিল ওই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির এক ছাত্রী। তারপর অজ্ঞান। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ভর্তি। ৭ দিন পর হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে ওই ছাত্রী জানায়, “পিছন থেকে আমার লম্বা চুল কেউ টেনে ধরেছিল। আমি ওখানেই পড়ে যাই। তারপর ক্লাসে এসে কী হয়েছিল, আমার মনে নেই। পরে বুঝতে পারি, আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম।” ওই ১২ নভেম্বরই ওই ছাত্রীকে দেবেন মাহাতো গভর্নমেন্ট মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ভর্তি করা হয় স্কুলের তরফে। একের পর এক পরীক্ষা করেও তার রোগ নির্ণয় করতে পারেননি চিকিৎসকরা। ফলে বাধ্য হয়ে ওই ছাত্রীকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
তখন স্কুলের এক শিক্ষিকা ওই পড়ুয়াকে টানা জিজ্ঞাসাবাদ করলে ভূতের গল্প সামনে আসে! তারপর স্কুল জুড়ে তা রটে যেতেই আতঙ্ক। ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক দেবজ্যোতি চক্রবর্তী বলেন, “স্কুলের এক ছাত্রী শৌচাগারে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। টানা ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট তার জ্ঞান ফেরেনি। ৭ দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি থেকে সমস্ত কিছু পরীক্ষা হয়। কিন্তু কেন মাথা ঘুরে পড়লো তার কোন কারণই জানা যায়নি। পরে ওই ছাত্রী স্কুলে এলে দিদিমণিরা তাকে জিজ্ঞাসা করে চুল টানা ভূতের গল্প জানতে পারেন। তবে এখন কোথাও কোনও আতঙ্ক নেই। পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ স্কুলে এসে প্রচার চালিয়েছে।”
স্কুল সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই ছাত্রী প্রতিদিন তার ঠাকুমার কাছে ভূতের গল্প শোনে। সম্প্রতি তার দিদি লাগদার স্কুলের হোস্টেলে ভূতের ভয়ে সেই ছাত্রী নিবাস ছেড়ে বাড়ি চলে আসে। স্কুলের শিক্ষকদের প্রাথমিক অনুমান, একদিকে রোজ ভূতের গল্প শোনা, সেইসঙ্গে দিদির ওই রকম ঘটনাতেই শিশুমনে একটা আতঙ্ক তৈরি হয়ে থাকতে পারে। স্কুল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা তো আর বুঝতে পারছিলেন না ছাত্রীর রোগ। তারা ভাবছিলেন, কোন অসুখেই মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছে। সেজন্যই তারা হাসপাতালে ভর্তি রেখে ওই ছাত্রীর রোগ নির্ণয়ে একাধিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন।
পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের পুরুলিয়া জেলা সাধারণ সম্পাদক নয়ন মুখোপাধ্যায় বলেন, “এই স্কুলের চুল টানা ভূতের গল্প শুনলাম। ওই আতঙ্কে এক ছাত্রী অজ্ঞান হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিল। আমরা বিভিন্নভাবে প্রচার করে পড়ুয়াদের বোঝানোর চেষ্টা করি ভূত বলে কিছু নেই। যদি কেউ ভূতের ছবি তুলে আনতে পারে তাহলে আমরা তাকে ৫ লক্ষ টাকা ইনাম দেব। কী করে ভূত ধরা যায়, সেই সব নিয়ে আমরা মজার খেলা দেখালাম। তাতে বাচ্চাদের ভয় ভেঙে আনন্দ তৈরি হয়। সেইসঙ্গে এই জেলায় বেগুনকোদর, অর্জুনজোড়া, কাশিপুর, নিতুড়িয়ার হোস্টেলে যে ভূতের গুজব রটেছিল, অথচ বাস্তবে যে কিছুই পাওয়া যায়নি সেই কথাও বলা হয়।” বিজ্ঞান মঞ্চ জানিয়েছে, এর মধ্য দিয়ে যাতে ভূতের ভয় ভেঙে যায় সেই চেষ্টাই করেন তারা। কিন্তু স্কুলের ওই শৌচাগারে যে চুল টানা ভূত! এই ভয়েই কাঁটা পড়ুয়ারা।