• BLO-দের চাপ হলে বাড়তি কর্মী দিক রাজ্য, সুপ্রিম নির্দেশ
    এই সময় | ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫
  • এই সময়: ভোটার লিস্টে বিশেষ নিবিড় সংশোধন প্রক্রিয়া (সার) চলাকালীন পশ্চিমবঙ্গে বেশ কয়েকজন বুথ লেভেল অফিসার (বিএলও) অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, কেউ মারা গিয়েছেন, কেউ বা আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন বলে অভিযোগ তুলে বারবার সরব হয়েছে রাজ্যের শাসকদল। এমনকী মৃত ও অসুস্থ বিএলও–দের পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণের কথাও মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন। শুধু বাংলা নয়, কেরালা, তামিলনাড়ু, গুজরাট, উত্তরপ্রদেশ–সহ অনেকগুলি রাজ্যেই একই অভিযোগ উঠেছে। বিএলও–দের উপরে এই অপরিসীম চাপের অভিযোগ অভিযোগ তুলে তৃণমূলপন্থী বিএলও অধিকার রক্ষা কমিটি লাগাতার বিক্ষোভ চালাচ্ছে রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের (সিইও) অফিসের সামনে। বৃহস্পতিবারও মৃত ও অসুস্থ বিএলও–দের পরিবারের সদস্যদের এনে প্রতিবাদ চালান তাঁরা। কিন্তু ‘সার’ ইস্যুতে একটি মামলায় এ দিনই তাৎপর্যপূর্ণ পর্যবেক্ষণ সুপ্রিম কোর্টের।

    ‘সার’ পিছনো বা স্থগিত করার দাবি জানিয়ে ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু ও কেরালার শাসকদল–সহ বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে শীর্ষ আদালতে। অভিনেতা বিজয়ের দল তামিলনাড়ুর তামিলাগা ভেত্রি কাঝাগাম (টিভিকে) তেমনই একটি মামলায় বিএলও–দের মৃত্যু ও অসুস্থতার জন্য দেশের নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) দায়ী করে একটি মামলা করেছিল। সেই মামলায় সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সূর্য কান্তের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ আঙুল তুলেছে সে রাজ্যের সরকারের দিকেই।

    মামলায় অভিযোগ করা হয়েছিল, জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের ৩২ নম্বর ধারাকে হাতিয়ার করে বিএলও–দের ভয় দেখানো হচ্ছে। এই ধারা অনুসারে, কোনও বিএলও বা নির্বাচনী আধিকারিকের কর্তব্যে গাফিলতি ধরা পড়লে তাঁর দু’বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে। বিজয়ের দলের অভিযোগ, এই আতঙ্কেই মৃত্যু হচ্ছে, অসুস্থ হয়ে পড়ছেন বিএলও-রা, ঠিক যে অভিযোগটা তুলে আসছে তৃণমূল কংগ্রেসও। শীর্ষ কোর্টে দাবি করা হয়, উত্তরপ্রদেশে বিএলও-দের বিরুদ্ধে ৫০টি মামলা দায়ের হয়েছে। যদিও কমিশনের আইনজীবী বিএলও–দের চাপ দেওয়ার অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। এ নিয়ে কমিশনকে দায়ী করতে নারাজ শীর্ষ আদালতও। সিজেআই সূর্য কান্ত জানিয়েছেন, বিএলও-রা রাজ্য সরকারের কর্মী, কমিশনের নন।

    বেঞ্চের পর্যবেক্ষণ, ‘কাজের জন্য আরও লোকের প্রয়োজন হলে রাজ্য নিয়োগ করতে বাধ্য।’ আদালত বলেছে, ‘সার’–এর কাজে যেখানে ১০ হাজার জনকে নিয়োগ করা হয়েছে, সেখানে আরও ৩০ হাজার জনকে নিয়োগ করা যেতেই পারে। সে ক্ষেত্রে চাপ কমতে পারে বিএলও-দের। প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ সংশ্লিষ্ট রাজ্যকে বলেছে, কোনও বিএলও কাজ থেকে অব্যাহতি চাইলে, বিশেষত কেউ অসুস্থ হলে, তাঁকে ছুটি দেওয়া হোক। সেই বিএলও-র বদলে নতুন বিএলও নিয়োগ করতে হবে। শুধু তামিলনাড়ু নয়, সংশ্লিষ্ট সব রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত রাজ্যের উদ্দেশেই এই নির্দেশ দিয়েছে শীর্ষ কোর্ট।

    এর আগে পশ্চিমবঙ্গের শাসকদলের অভিযোগের ভিত্তিতে কমিশনও বিএলও–দের কাজের চাপের কথা পুরোপুরি অস্বীকার করেনি। সেই অনুযায়ী, যে সব বুথে ভোটারের সংখ্যা বেশি, সেখানে বিএলও–কে সাহায্য করতে সহকারী বিএলও নিয়োগ করা হয়েছে। তবে এ দিন সুপ্রিম কোর্ট যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে, তার প্রেক্ষিতে অনেকের প্রশ্ন, এনিউমারেশন পর্ব যখন প্রায় শেষ পর্যায়ে সেখানে এই বাড়তি কর্মী নিয়োগ করে কোনও লাভ হবে কি? যদিও কমিশন সূত্রের দাবি, এনিউমারেশন ফর্ম ডিজিটাইজ়েশনের পরেও বেশ কিছু কাজ বাকি থাকবে। র‌্যান্ডম ভেরিফিকেশন, বেশ কিছু ক্ষেত্রে সন্দেহজনক ভোটারের বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নেওয়া, তথ্য ঝাড়াইবাছাইয়ের কাজ এখনও চলবে। খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশের পরে ফর্ম–৬ জমা দিয়ে নতুন ভোটারের নাম তোলার কাজও চলবে। ফলে প্রয়োজন অনুযায়ী আরও বিএলও নিয়োগ করা যেতেই পারে।

    এই আইনি টানাপড়েনের মধ্যে এ দিনও রাজ্যের সিইও দপ্তরের সামনে বিএলও অধিকার রক্ষা কমিটির অবস্থান–বিক্ষোভ অব্যাহত ছিল। বেলা আড়াইটে নাগাদ মঞ্চে এসে হাজির হন মুর্শিদাবাদের খড়গ্রাম বিধানসভা কেন্দ্রের প্রয়াত বিএলও জাকির হোসেনের ছেলে এমাদুল হোসেন, পূর্ব বর্ধমানের মেমারি–২ নম্বর ব্লকের প্রয়াত বিএলও নমিতা হাঁসদার স্বামী মাধব হাঁসদা এবং হাওড়ার ডোমজুরের অসুস্থ বিএলও অর্নিবাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী মৌমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সে সময়ে তৃণমূলপন্থী সংগঠনটির সদস্যরা তিন পরিবারের লোকজনকে নিয়ে সিইও দপ্তরে ঢোকার চেষ্টা করেন। পুলিশি ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টাও হয়। পুলিশের সঙ্গে সামান্য ধস্তাধস্তির পরে এক সময়ে বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় বসে পড়েন। বিবাদী বাগ চত্বরে যান চলাচলও ব্যাহত হয়। ডিসি (সেন্ট্রাল) ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে পুলিশবাহিনী পরিস্থিতি সামাল দেয়। বিক্ষোভকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে লাঠিতে বাঁধা প্ল্যাকার্ড ছোড়েন। তাঁদের অভিযোগ, ‘বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী এলে সিইও দেখা করতে পারলে আমাদের সঙ্গে নয় কেন?’

    ওই মঞ্চ থেকে পরে মৌমিতা বলেন, ‘আমার স্বামী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন শোনার পরেও ইআরও অফিস থেকে বলা হয়েছে, আপনার স্বামীর কাজ আপনাকে করে দিতে হবে। সেই মতো ৮০-৯০টি এনিউমারেশন ফর্ম আমরাই আপলোড করে দিই।’ অধিকার রক্ষা কমিটির বাপ্পাদিত্য গুহ কমিশনের বিরুদ্ধে অমানবিক আচরণের অভিযোগ করেন। পরে অতিরিক্ত সিইও দিব্যেন্দু দাস বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে বসতে সম্মত হলে তিন জনের পরিবারকে নিয়ে ছ’জন বিএলও সিইও দপ্তরে যান। যদিও সিইও মনোজ আগরওয়াল তাঁদের সঙ্গে দেখা করেননি। তিনি জানিয়ে দেন, ‘বিএলও–দের সমস্যা সংশ্লিষ্ট ইলেক্টোরাল রেজিস্ট্রেশন অফিসার (ইআরও) বা জেলা নির্বাচনী আধিকারিকরা (ডিইও) দেখবেন। তাঁদের কাছে ওঁরা যেতে পারেন।’ হাওড়ার জেলাশাসক দীপপ্রিয়া পি জানিয়েছেন, স্বাস্থ্যসাথী কার্ড করিয়ে অনির্বাণের চিকিৎসা করানো হচ্ছে।

    এর মধ্যেই হাওড়ার ডোমজুড়ের আরও এক বিএলও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বুধবার মাঝরাতে ডোমজুড়ের ১৪৮ নম্বর বুথের বিএলও ওয়াসিম পারভেজ গুরুতর অসুস্থ হয়ে বাঁকড়ার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তিনি বাঁকড়ার একটি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক। তাঁর পরিবারের সদস্যদের দাবি, অত্যধিক কাজের চাপে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছেন ওই বিএলও। তিনি ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছেন, এই অসহ্য কাজের চাপ নিতে পারছেন না। এর থেকে মৃত্যুও ভালো। বছর আটত্রিশের পারভেজের আদি বাড়ি কৃষ্ণনগরে। কর্মক্ষেত্রের কাছে বাঁকড়ায় তিনি একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করে একাই থাকেন। বাড়িতে রয়েছেন সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী। সেই নিয়েও দুশ্চিন্তায় ছিলেন পারভেজ। স্থানীয় সূত্রে খবর, ওই বিএলও বুধবার গভীর রাতে নিজের ফ্ল্যাটে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর পরিবারের দাবি, গত বছর তাঁর অস্ত্রোপচার হয়েছিল। এমনিতেই বেশি পরিশ্রমের কাজ করার ক্ষেত্রে অসুবিধা রয়েছে তাঁর। সব জানিয়েও বিএলও–র দায়িত্ব থেকে রেহাই পাননি তিনি। এই অবস্থায় আত্মহত্যা ছাড়া পথ নেই বলে আক্ষেপ অসুস্থ বিএলও–র। তিনি হাওড়ার জেলাশাসকেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

  • Link to this news (এই সময়)