আজকাল ওয়েবডেস্ক: মুর্শিদাবাদ ও মালদহ জুড়ে শুক্রবার সিপিআই(এম)-এর ‘বাংলা বাঁচাও যাত্রা’ ঘিরে তৈরি হল আলাদা রাজনৈতিক আবহ। ফারাক্কা থেকে সমশেরগঞ্জ পর্যন্ত চলা এই কর্মসূচিতে বারবার থেমে পথের ধারে দাঁড়ানো মানুষের সঙ্গে কথা বললেন বাম নেতারা। বাইক মিছিল থামতেই ভিড় জমল দোকান আর বাজারঘাটে। উপস্থিতদের মধ্যে ছিলেন বিড়ি শ্রমিক, পরিযায়ী শ্রমিক, ছোটখাটো ব্যবসায়ী ও গ্রামাঞ্চলের যুবকরা।
দিনটি ছিল ৬ ডিসেম্বর—বাবরি মসজিদ ধ্বংসের দিন। আজকেও সেই ৬ ডিসেম্বর। এই পরিস্থিতিতে সিপিআই(এম)-এর যাত্রা সম্প্রীতির বার্তা সঙ্গে নিয়ে মেরুকরণের রাজনীতির বিরুদ্ধে তীব্র অবস্থান নেয়।
ফরাক্কায় আয়োজিত জনসভায় বক্তব্য রাখেন কেরালায় কর্মরত পরিযায়ী শ্রমিক তারিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, কেরালায় দিনে এক হাজার টাকা মজুরি এবং থাকার ব্যবস্থা নিয়োগকর্তার দায়িত্ব। সবচেয়ে বড় কথা—সেখানে তাঁদের ‘অতিথি শ্রমিক’ বলা হয়। তাঁর বক্তব্যে কর্মসংস্থান নিয়ে ক্ষোভ ফুটে ওঠে স্থানীয় মানুষের।
সমশেরগঞ্জে সভায় জেলা সম্পাদক জামির মোল্লা অভিযোগ করেন, বিড়ি শিল্পের মালিকরাই এখন মন্ত্রী-সাংসদ। অথচ শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি নেই। তিনি আরও অভিযোগ তোলেন, সমশেরগঞ্জ-জঙ্গিপুরের দাঙ্গায় প্রশাসন নীরব ছিল এবং তৃণমূল ও বিজেপি ধর্মীয় উত্তেজনা ছড়িয়ে লাভ তুলেছে। এনআরসি, ওয়াকফ সংশোধনী এবং এসআইআর আইন নিয়েও রাজ্যের বিরোধিতা করেন তিনি।
সমাবেশ ঘুরলেই চোখে পড়েছে একদিকে মাইক্রোফিন্যান্স ঋণের বোঝা, অন্যদিকে ব্যাপক বেকারত্ব। বহু পরিবার জানায়, ঋণের কিস্তি দিতে না পারলে রাতদুপুরে বাড়িতে বাউন্সার গিয়ে ধমকায়। যাদের সন্তান পড়ে বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে, তাঁদের মুখে এখন স্কুল ফি ও টিউশনের চাপ। সরকারি স্কুলে শিক্ষক সংকট নিয়ে অভিযোগ তুলেছেন কলেজ পড়ুয়া শুভ মণ্ডল।
সবচেয়ে করুণ চিত্র দেখা গেল ভুতনির চরে। নদীভাঙনে ঘরহারা প্রায় ৫০০ পরিবার বর্তমানে অস্থায়ী বাঁধের ওপর প্লাস্টিক-টিনের ঘরে আশ্রয় নিয়েছে। জল, আলো, স্বাস্থ্যব্যবস্থা—কিছুই নেই। পরিবারগুলির অধিকাংশ পুরুষ সদস্যই পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে গেছেন দিল্লি, গুজরাট বা উত্তর ভারতের শিল্পাঞ্চলে। তাঁদের দাবি—ভাঙনে হারানো জমির পুনর্বাসন, স্থায়ী বাঁধ এবং মৌলিক সরকারি সুবিধা।
দিনভর জনসভায় বক্তব্য রাখেন রামচন্দ্র ডোম, সোমনাথ সিংহ রায়, ময়ুখ বিশ্বাস, দীপ্সিতা ধর, মীনাক্ষী মুখার্জি, কৌশিক মিশ্র এবং মহম্মদ সেলিম। দীপ্সিতা ধর বলেন, যেখানে যুবকদের কাজ নেই, হাসপাতালে বেড নেই, সেখানে মন্দির-মসজিদ রাজনীতি মানুষের আসল সমস্যা থেকে মন সরিয়ে নিতে তৈরি করা হচ্ছে।
সন্ধের দিকে বাইক মিছিল শেষ হলে নেতারা তরুণদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। অনেকে চাকরি, শিক্ষা এবং নিরাপত্তা নিয়ে তাঁদের হতাশার কথাও জানান।
দিনের শেষে যাত্রার মূল সুর ছিল পরিষ্কার—ধর্ম নয়, অধিকারই রাজনীতির কেন্দ্র হওয়া উচিত। মানুষ জানালেন তাঁদের দাবি: কাজ, স্কুল, হাসপাতাল, নিরাপত্তা এবং দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন। আর সিপিআই(এম) দাবি তুলল—এই সংগ্রামে মানুষকেই সামনে আসতে হবে।