তৃণমূলের ধাঁচেই পথে নামলেও বিসমিল্লায় গলদ! ‘বাংলা বাঁচাও যাত্রা’ কি বাঁচাতে পারবে সিপিএমকে?
প্রতিদিন | ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫
সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: মিল একাধিক। পঞ্চায়েত ভোটের ঠিক আগে আগেই ‘নবজোয়ার যাত্রা’ করেছিল তৃণমূল। সিপিএমও একই ধাঁচেই ‘বাংলা বাঁচাও যাত্রা’ (Bangla Bachao Yatra) শুরু করেছে বিধানসভা ভোটের আগে। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো মহম্মদ সেলিম এবং মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়েরাও কোচবিহার থেকেই পদযাত্রা শুরু করেছেন। কিন্তু অমিল একটাই। তৃণমূলের ‘নবজোয়ার যাত্রা’র মতো দৃশ্যত কোথাও ‘চমকপ্রদ’ সাড়া নেই সেলিমদের এই কর্মসূচিতে!
এ নিয়ে শাসক তৃণমূল এবং বিজেপি তো কটাক্ষ করছেই, দলের অন্দরেও প্রশ্নের মুখে নেতৃত্ব। দলের অনেকেরই অভিমত, পঞ্চায়েত ভোট স্থানীয় স্তরের নির্বাচন হওয়ায় তৃণমূল সেই সময়কালকেই বেছে নিয়েছিল বুথের সংগঠনকে মজবুত করার জন্য। ফলে পঞ্চায়েত ভোট তো বটেই, লোকসভা নির্বাচনের সময়েও তার সুফল পেয়েছিল শাসকদল। অর্থাৎ, সুপরিকল্পিত প্রস্তুতি। কিন্তু সিপিএমের আচরণ ‘শূন্য পাওয়া ছাত্রের মতোই’। পরীক্ষার মুহূর্তে কোনও রকমে সিলেবাস শেষ করার চেষ্টা। কিন্তু যে হেতু ‘বিসমিল্লায় গলদ’, ফলে যা হওয়ার, তা-ই হবে।
রাজ্য জুড়ে যাবতীয় বিতর্ক এখন ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধনকে (এসআইআর) ঘিরে। এই শোরগোলের মধ্যে জনজীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য প্রশ্ন যাতে হারিয়ে না যায়, সে দিকে নজর রেখে এসআইআর চলাকালীনই ‘বাংলা বাঁচাও যাত্রা’য় নেমেছে সিপিএম। গত ২৯ নভেম্বর কোচবিহারের তুফানগঞ্জ থেকে শুরু হয়েছে এই যাত্রা। কোচবিহার থেকে তা আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, মালদহ, দুই দিনাজপুর হয়ে দক্ষিণবঙ্গে প্রবেশ করবে। চলবে প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে। শেষ আগামী ১৭ ডিসেম্বর, উত্তর ২৪ পরগনার কামারহাটিতে। উদ্দেশ্য- নিচুতলার সংগঠনে ঝাঁকুনি। বুথের সংগঠনকে মজবুত করা।
২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের আগেও ‘ইনসাফ যাত্রা’ করেছিল সিপিএম। তখন যাত্রার মুখ করা হয়েছিল দলের যুব সংগঠনের তৎকালীন রাজ্য সম্পাদক মীনাক্ষীকে। কিন্তু ওই কর্মসূচির কোনও প্রভাব ভোটবাক্সে পড়েনি। কাটেনি শূন্যের গেরোও! অতীতেও এই ধরনের কর্মসূচির সামনের সারিতে থাকতেন বিমান বসু। কিন্তু এ বার সেই পথে না হাঁটেনি আলিমুদ্দিন। ‘বাংলা বাঁচাও যাত্রা’য় তারা গুরুত্ব দিচ্ছে স্থানীয় স্তরে ‘পরিচিত মুখ’দের। কিন্তু নীতি বদলেও হোঁচট খেতে হল সিপিএম নেতৃত্বকে!
যেখান থেকে যাত্রা শুরু হয়েছে, সেই কোচবিহারের তুফানগঞ্জের স্থানীয় নেতৃত্বের দাবি, আশানুরূপ সাড়া মেলেনি। গত পঞ্চায়েত এবং লোকসভা নির্বাচনের সময় থেকেই দলে যুব নেতানেত্রীদের গুরুত্ব দিতে শুরু করেছিলেন নেতৃত্ব। কিন্তু ‘বাংলা বাঁচাও যাত্রা’য় সেই যুব নেতানেত্রীদের দেখা সেই ভাবে মেলেনি। স্রেফ কিছু পুরোনো নেতা-কর্মী লাল ঝান্ডা হাতে পদযাত্রায় হেঁটেছেন। যাত্রার পর নিচুতলার সংগঠনেও যে আলোড়ন পড়ার কথা ছিল, তা-ও চোখে পড়েনি। উল্টে, যাত্রা আলিপুরদুয়ারে প্রবেশ করা মাত্রই কোচবিহার দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্রে (সেখানকার বিধায়ক বিজেপির) কয়েকটি পার্টি অফিসে হামলা হয়।
ঘটনাচক্রে, এই কোচবিহার এককালে বামেদের ঘাঁটি ছিল। কিন্তু ২০১১ সালে রাজ্যে পালাবদলের পর থেকেই সেখানে সংগঠনে অবক্ষয় শুরু হয়। একে একে দল ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেন নেতারা। সিপিএমের শরিক দল ফরওয়ার্ড ব্লক থেকে শাসকদলে গিয়েছেন উদয়ন গুহ, পরেশচন্দ্র অধিকারী এবং জগদীশচন্দ্র বর্মা বসুনিয়ার মতো নেতারা।
কোচবিহার জেলা সিপিএমের সম্পাদক অনন্ত রায় অবশ্য বলছেন, পদযাত্রায় ভালই সাড়া মিলেছে। নিচুতলার প্রচুর কর্মীই তাতে যোগ দিয়েছেন, যা সংগঠনের পক্ষে যথেষ্টই সদর্থক। পদযাত্রায় সেলিমেরও দাবি, সাধারণ মানুষ তাঁদের দু’হাত তুলে সমর্থন করছেন। কিন্তু বাস্তব ছবি যে সম্পূর্ণ ভিন্ন, তা একান্তে স্বীকার করে নিচ্ছেন দলের নিচুতলার নেতা-কর্মীরাই।
তেমন ভিড় লক্ষ করা যায়নি আলিপুরদুয়ার শহরেও। বাইকের সংখ্যাও ছিল হাতে গোনা। একই ছবি জলপাইগুড়িতেও। শহরের এক প্রান্তে সমাবেশ করেছিলেন দলের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম, যুবনেত্রী মিনাক্ষীরা। কিন্তু সেখানেও সাধারণ মানুষের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা যায়নি। স্থানীয় এক সিপিএম নেতা বলেন, ‘‘২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন পরিবর্তনের ডাক দিয়ে সভা করতেন, কত কত মানুষ যে ছুটে যেতেন, তা নিজের চোখে দেখেছি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখতেই মানুষ যেতেন। কিন্তু আমরা সেই জায়গায় এখনও নিজেদের নিয়ে যেতে পারিনি। এই ব্যর্থতা স্বীকার করতেই হবে।’’
দলের একাংশের এ-ও অভিমত, এই ধরনের কর্মসূচি পরিকল্পনাতেই গলদ রয়েছে। শাসকদল ‘নবজোয়ার যাত্রা’ শুরু করার আগে রাজ্য জুড়ে একটা আবহাওয়া তৈরি করেছিল। তার জন্য প্রচুর প্রস্তুতি সভা হয়েছে। একেবারে বুথস্তরের কর্মীদের সক্রিয় করা হয়েছিল, যাতে যতটা সম্ভব বেশি মানুষের সাড়া পাওয়া যায়। জনতার কাছে কী ভাবে পৌঁছে যেতে হবে, তার জন্য প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সিপিএম নেতৃত্ব সে সব কিছুই করেননি। আগাম প্রস্তুতি না থাকলে এই ধরনের কর্মসূচি সফল হয় না বলেই মত দলের ওই অংশের।
যদিও সেলিম পদযাত্রায় অংশ নিচ্ছেন। লাগাতার সুরও চড়াচ্ছেন তৃণমূল এবং বিজেপির বিরুদ্ধে। সমাবেশে যাচ্ছেন মীনাক্ষীও। কিন্তু দলের একাংশের অভিযোগ, অন্য শীর্ষ নেতাদের থেকে যে রকম অংশগ্রহণ প্রত্যাশা করেন কর্মী-সমর্থকেরা, এই যাত্রায় তা দেখা যায়নি এখনও পর্যন্ত। যুব নেতানেত্রীরাও সেই অর্থে সক্রিয় নন।
তা ছাড়া আলিপুরদুয়ারের ভাটাবাড়ির এক তরুণ সিপিএম নেতার বক্তব্য, ‘‘জনসংযোগ যাত্রার পাশাপাশি লক্ষ্মীর ভান্ডার, কন্যাশ্রী, স্বাস্থ্যসাথীর মতো বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের প্রচার করেছিল তৃণমূল। তাতে মানুষ আরও বেশি করে আকৃষ্ট হয়েছেন। আমরা সে সব কিছুই করতে পারছি না। সঠিক বিকল্প তুলে ধরতে না পারলে মানুষ কখনওই সাড়া দেবে না।’’
তৃণমূলের ‘নবজোয়ার’ প্রায় সাড়ে চার হাজার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেছিল। সেখানে সিপিএমের যাত্রা উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রায় এক হাজার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করবে। যাবে রাজ্যের ১১টি জেলায়। মূল যাত্রা থেকে বাদ থাকছে হাওড়া, পূর্ব মেদিনীপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং কলকাতা। যা নিয়েও দলের অন্দরে প্রশ্ন উঠেছে। একাংশের বক্তব্য, ভোটে ভাল ফল বা সাংগঠনিক ভাবে দলের ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা নেই বলেই কি এই সব জায়গাকে বাদ রাখা হয়েছে?
নেতৃত্বের অবশ্য দাবি, যেখানে মূল যাত্রা যাবে না, সেখানে উপযাত্রা হবে। কিন্তু তাতে কি সংগঠন মজবুত হবে? পূর্ব মেদিনীপুরের এক প্রবীণ সিপিএম নেতার ক্ষোভমিশ্রিত জবাব, ‘‘সঠিক পরিকল্পনার অভাব। এমনিতেই এ সব জায়গায় কর্মীরা কোণঠাসা। শুধুমাত্র যেখানে ভোটে জিততে পারব বলে মনে হচ্ছে, সেখানেই কর্মসূচি হবে, বাকি জায়গায় হবে না, এটা করলে চলবে না। আলোড়ন ফেলতে চাইলে, সর্বত্রই সেই চেষ্টা করতে হবে। নইলে ঘুরে দাঁড়ানো অসম্ভব।’’
২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে হতাশাজনক ফলাফলের পর সিপিএমের অভ্যন্তরীণ রিপোর্টে বলা হয়েছিল, দলের একাংশ সদস্য সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করেননি। নির্বাচনের সময় তাঁরা নিষ্ক্রিয় ছিলেন। আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে তার পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, সেই মর্মে ইতিমধ্যেই দলের অন্দরে বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। স্পষ্ট নির্দেশ, দলীয় সদস্যদের নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করতে হবে। নিজেদের পার্টি অফিসের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে জনগণের কাছে যেতে হবে। নিয়মিত থাকতে হবে দলীয় বৈঠকেও। দায়িত্ব পালনে গাফিলতি থাকলে দলীয় স্তরে কড়া পদক্ষেপ করা হবে বলেও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শীর্ষ নেতৃত্বের এই নির্দেশের পরেও কেন ‘বাংলা বাঁচাও যাত্রা’য় নজরকাড়া সাড়া মিলছে না, তা নিয়ে দলের অন্দরে আলোচনা শুরু হয়েছে।
দলের একাংশের যুক্তি, তৃণমূলের বুথ সংগঠন এমনিতেই শক্তপোক্ত। তার পরেও শাসকদল গোটা সংগঠনকে বুথ স্তরে নামিয়ে এনেছে এসআইআর আবহে। তারা সাধারণ মানুষের হয়রানির কথা শুনছে। মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে। যা স্বাভাবিক ভাবেই জনমানসে প্রভাব ফেলে। কিন্তু সিপিএমের বুথকর্মীদের বড় অংশ এসআইআরের কাছে নিজেদের মনোনিবেশ করতে পারছেন না। উল্টে দলের সাংগঠনিক কর্মসূচি না এসআইআরের বুথভিত্তিক কাজ- কোন দিক সামলাবেন, তা নিয়ে তাঁরা বিভ্রান্ত। তাই কর্মসূচি ফলপ্রসূ না হওয়ার দায় তাঁদের উপরেও চাপানো যায় না।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের মত, সিপিএমের নিচুতলার কর্মীদের বিভ্রান্ত হওয়ার আরও কারণ রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হল ‘নীতিপঙ্গুত্ব’। প্রথমত, আদৌ কংগ্রেসের সঙ্গে দলের জোট হবে কি না, এখনও জানেন না নেতা-কর্মীরা। ফলে সেই মতো ভোট-পরিকল্পনা বা প্রস্তুতি নেই। দ্বিতীয়ত, বিরোধিতার মূল লক্ষ্য কে হবে, বিজেপি না কংগ্রেস, তা নিয়েও বিভ্রান্তি রয়েছে। এই সংক্রান্ত কোনও স্পষ্ট বার্তা না থাকায় নিচুতলার কর্মীদের একটা বড় অংশ ক্ষুব্ধও।
সিপিএমের এই কর্মসূচি নিয়ে কটাক্ষ করেছে তৃণমূল। শাসকদলের রাজ্য সহ-সভাপতি জয়প্রকাশ মজুমদার বলেন, ‘‘রবীন্দ্রনাথের একটা গানের লাইন আছে— ‘না বাঁচাবে যদি আমায়, মারবে কেন তবে?’ ৩৪ বছরে বাংলাকে শেষ করে দিয়েও তাদের আশা শেষ হয়নি এখনও। শূন্যতে পৌঁছে গিয়েও, এখনও শূন্যের মধ্যেই স্বপ্ন দেখছে। সিপিএমকে আগামী দিনে বাংলার মানুষ মহাশূন্যে পাঠাবে।’’
তবে কংগ্রেসের মত, রাজনীতি সম্ভাবনাময়। সিপিএমের যাত্রা ফলপ্রসূ হবে কি না, তা সময়ই বলবে। প্রদেশ কংগ্রেস মুখপাত্র অশোক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘সিপিএম নিজেদের মতো একটা স্বতন্ত্র প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি আমরাও একই চেষ্টা করে যাচ্ছি। ব্লকে ব্লকে যাচ্ছি। মানুষের সঙ্গে কথা বলছি, তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আমরাও।’’
বিহারেও বিধানসভা ভোটের আগে ‘ভোটার অধিকার যাত্রা’ করেছিলেন রাহুল গান্ধী, তেজস্ব যাদবেরা। তাতে সাড়া মিলেছিল ভালই। কিন্তু ভোটবাক্সে তার প্রতিফলন দেখা যায়নি। পদযাত্রার পর ভোটের ময়দান থেকে কার্যত উধাও হয়ে গিয়েছিলেন রাহুল। নির্বাচনে যার খেসারত দিতে হয়েছে বিরোধী জোটকে। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে বাংলায় সিপিএমের কর্মসূচিতে এমনিতেই সাড়া নেই। তার পরেও নেতৃত্ব কোন যুক্তিতে এত আশাবাদী, তা নিয়ে দলের অন্দরেই প্রশ্ন রয়েছে। সন্দিহানও অনেকে। সিপিএমের এক রাজ্য নেতারই কথায়, ‘‘বাকিরা যা করছে, আমরাও তা-ই করলে কিছুই হবে না। মাঠেঘাটে পড়ে থাকতে হবে। দলে মন্থন দরকার। নইলে পুনরুত্থান অসম্ভব।’’