সত্যজিৎ রায়ের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ হোক বা তপন সিনহার ‘আপনজন’, একের পর এক সুপারহিট সিনেমায় তাঁর অভিনয় মুগ্ধ করেছে দর্শককে বার বার। রবিবার রাতে অভিনেতা কল্যাণ চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণ মুহূর্তে মনে করিয়ে দিয়েছে ‘এক আকাশের নিচে’ ধারাবাহিকের সেই সদা হাস্যমুখ ‘কানাইদা’কে। দীর্ঘ বছরের স্মৃতি ভিড় করে আসছে ‘দাশগুপ্ত পরিবারের’ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মনেও। শুটিং সেটের প্রতিদিনের নানা খুনসুটি, মজার গল্প আর একঝাঁক অভিজ্ঞতাই এখন সঙ্গী হয়ে রয়ে যাবে। ফেলে আসা সময়ের নানা মুহূর্ত ভাগ করলেন ‘কানাই’-এর সহ-অভিনেতারা।
শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়
মাসখানেক আগে একবার ফোন করেছিলেন কল্যাণদা। সম্ভবত কারও একটা নম্বর নেওয়ার জন্য। একাই থাকতেন মানুষটা। বয়সের তুলনায় চেহারাটা খুব স্লিম রেখেছিলেন। শেষ ‘বৌদি ডট কম’ বলে একটি সিনেমায় কাজ করেছিলাম একসঙ্গে। ভাইজ়্যাগে শুটিং করেছিলাম মনে আছে। আর ‘এক আকাশের নিচে’ নিয়ে আর কী-ই বা বলি। একসঙ্গে সাড়ে পাঁচ বছর কাজ করেছিলাম। একেবারে পরিবারের মতো ছিল। বড্ড রসিক মানুষ ছিলেন কল্যাণদা। কত আড্ডা হতো। শুধু সেই দিনগুলোকে মনে করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।
চৈতি ঘোষাল
‘এক আকাশের নিচে’র ‘কানাইদা’ আজীবন থেকে যাবে আমার হৃদয়ে। একঝাঁক অভিনেতা-অভিনেত্রী হইহই করে কাজ করেছি। একটা সত্যিকারের পরিবার ছিল। যখন একটা ধারাবাহিক জনপ্রিয় হয়, তখন সেগুলো অনেকদিন ধরে চলে এবং শেষ হয়ে গেলে সকলেরই মন খারাপ হয়। তার পরে যোগাযোগ হয়তো অতটা থাকে না। আবার নতুন কাজ শুরু হয়ে যায়। তবে ওই প্রোজ়েক্টে যাঁরা কাজ করেছিলাম তাঁরা অন্যান্য যে কাজই করি না কেন, এখনও ‘এক আকাশের নিচে’র বন্ধনেই আটকে রয়েছি। কল্যাণদাকে তো আমি ছোটবেলা থেকে চিনি। আমার বাবার সঙ্গে প্রচুর ছবিতে কাজ করেছেন, থিয়েটারে কাজ করেছেন। তবে যে যা নামেই ডাকুক আমার কাছে কল্যাণদা সবসময়ই ‘এক আকাশের নিচে’র কানাইদা হয়েই থাকবে। এত ভালো ভালো কিছু সিন রয়েছে যেটা বলার নয়। মানুষের মনে গেঁথে গিয়েছিল ‘কানাইদা’। ৮১-৮২ বছর বয়সে কল্যাণদা চলে গেলেন। আমি কিন্তু বলব খুব ভালো একটা জীবনযাপন করেছেন মানুষটা। ছোটদের সঙ্গে মজা করতে পারতেন। আমার যে পাইলট, যিনি ২৫ বছর ধরে আমার সঙ্গে রয়েছেন, তাঁরও বন্ধু কল্যাণদা। খুব বাঁধন ছাড়া একজন মানুষ। নিজের মতো করে জীবন এনজয় করেছেন।
রজতাভ দত্ত
ছোটবেলা থেকে তপন সিনহার ছবি বা অন্যান্য একটু সিরিয়াস ছবি যে গুলো হতো সেখানে তাঁর অসাধারণ অভিনয় দেখেছি। আর ‘এক আকাশের নিচে’র সময়ে কল্যাণদাকে সবচেয়ে বেশি কাছ থেকে দেখেছি। প্রতিদিনই সিন থাকত কল্যাণদার। আমি বহু বছর আগে দাদার বাড়িতেও গিয়েছি। মাঝে একবার দেখা হয়েছিল তখন চোখে কিছুটা সমস্যা হচ্ছিল। সবচেয়ে বড় গুণ ছিল কখনও কারও সম্পর্কে ভুল করেও সমালোচনা, নিন্দা বা পরচর্চা করতে দেখিনি। খুবই স্নেহপ্রবণ ছিলেন। এক আকাশের আনাচে-কানাচে কল্যাণদার স্মৃতি জড়িয়ে থাকবে আজীবন।
দেবলীনা দত্ত
কল্যাণদা তো আসলে আমাদের বাড়ির মানুষ। আর ‘এক আকাশের নিচে’র ওই ‘দাশগুপ্ত পরিবার’ আমার বড্ড নিজের। এখনও আমি নিজেকে ওই পরিবাররেই একজন সদস্য বলে থাকি। এখনও আমার ‘নন্দিনী’ হিসেবেই বহু জায়গায় পরিচয় দেওয়া হয়। আমার জীবনে তাই এই পরিবারের প্রতিটি সদস্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। ‘আম্মা’, ‘কানাইদা’ আর ‘তরুদি’ হলেন আমার অভিভাবক, পথপ্রদর্শক। ওঁরা একেবারেই আমার পরিবারের সেই সদস্যটির মতো যাঁদের হাত সবসময় আমার মাথায় থাকে। ‘কানাইদা’ সারাজীবন আমার কাছে পরিবারের একজন সদস্য। তাই কিছুতেই কল্যাণদা বলে ওঠা হয়নি কখনও। সবসময় ‘কানাইদা’-ই হয়ে থেকে যাবেন। ‘এক আকাশের নিচে’র সহ-অভিনেতারা তো আমায় গড়ে তুলেছিলেন। সেটা না হলে আমি আজকের দেবলীনা হতাম না। তার মধ্যে ‘কানাইদা’র একটা বড় অবদান। তাই পরিবারের কোনও সদস্যের বিয়োগ হলে যে কষ্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, গতকাল রাত থেকে তেমনই কষ্টের মধ্যে দিয়েই যাচ্ছি। কিছুই যেন ভালো লাগছে না।
ভাস্বর চট্টোপাধ্যায়
কল্যাণদার সঙ্গে ‘এক আকাশের নিচে’তে আমার ট্র্যাক ছিল না ঠিকই, তবে ওঁর সঙ্গে আমি অন্য কাজ করেছি। এমন হাসিখুশি মানুষ খুব কম দেখেছি ইন্ডাস্ট্রিতে। যতদূর মনে পড়ছে একটা টেলিফিল্মে অভিনয় করেছিলাম। পুরোনো দিনের কত গল্প শুনেছি তাঁর থেকে। পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের সেই সময়ে পড়াশোনা করেছেন। এমন অভিনেতা আর কখনও ফিরে আসবে না। ওই সময়কার একজন একজন করে সকলে চলে যাচ্ছেন। এই মানুষগুলোর অভিজ্ঞতা যদি আর্কাইভ করে রাখা যেত, তা হলে সেটা বড় পাওয়া হতো সব প্রজন্মের।