সমুদ্র গিলে খেয়েছে সুন্দরবনের আস্ত ২ দ্বীপ, কোন কোন শহরে বড় বিপদ? জানুন
আজ তক | ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫
Sundarban Mangrove Crisis: বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবন হাজার হাজার মানুষের জীবনকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে আসছে। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এই প্রাকৃতিক ঢালটিই আজ সবচেয়ে বড় সংকটে। গত তিন দশকে সুন্দরবনের কয়েকটি দ্বীপ কার্যত বিলুপ্তির পথে। বন সমীক্ষা দফতরের (FSI) ২০২৩ সালের রিপোর্ট বলছে, দেশে মোট ম্যানগ্রোভের বিস্তার এখন ৪,৯৯২ বর্গকিলোমিটার, যা ২০২১ সালের তুলনায় কমেছে ৭.৪৩ বর্গকিলোমিটার।
ভাঙাদুনি দ্বীপ
সুন্দরবনের দক্ষিণ প্রান্তে ভাঙাদুনি দ্বীপ একসময় ঘন জঙ্গলে ঢাকা ছিল। ১৯৭৫ সালের সার্ভে অফ ইন্ডিয়া এবং ল্যান্ডস্যাট-২ স্যাটেলাইট ছবিতে দ্বীপটিকে স্পষ্ট দেখা গেলেও ১৯৯১ সালের ল্যান্ডস্যাট-৫ ছবিতে দ্বীপের আকার কমতে শুরু করে। সাগরের ঢেউ আর অতিরিক্ত লবণের প্রভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে ম্যানগ্রোভের শিকড়। ২০১৬ সালের ল্যান্ডস্যাট-৮ ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ১৯৭৫ সালের তুলনায় দ্বীপটির প্রায় অর্ধেকই জলমগ্ন। বনবিশেষজ্ঞ অনুপম ঘোষের মতে, ১৯৯১ থেকে ২০১৬তে ২৩ বর্গকিলোমিটার জমি সমুদ্রের তলায় মিলিয়ে গিয়েছে।
জম্বুদ্বীপ
জম্বুদ্বীপের অবস্থাও একই রকম। ১৯৯১ সালে বড়সড় আকারে ধরা পড়লেও ২০১৬ সালে দ্বীপটির নীচের অংশ প্রায় উধাও। ঢেউয়ের ধাক্কায় ক্রমাগত সরে যাচ্ছে এবং ক্ষয় হচ্ছে জমি। নাসা ও WWF-এর ২০২৪-২৫ সালের উপগ্রহ বিশ্লেষণ জানাচ্ছে, সুন্দরবনের ভূমিক্ষয় বছরে ৩ সেন্টিমিটার হারে হচ্ছে, যা বিশ্বের গড়ের দ্বিগুণ।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই বিপদের মূল কারণ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি। আইপিসিসির ২০২৩ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, বরফ গলার ফলে এবং সমুদ্রের জল উষ্ণ হয়ে প্রসারিত হওয়ায় বিশ্বজুড়ে সমুদ্রপৃষ্ঠ বাড়ছে। সুন্দরবনে এই বৃদ্ধি প্রতি বছর ৩.৯ মিমি. যেখানে বৈশ্বিক গড় ১.৭ মিমি। লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় দ্রুত মারা যাচ্ছে ম্যানগ্রোভের শিকড়, মাটি বেঁধে রাখার ক্ষমতাও কমছে। ম্যানগ্রোভ ধ্বংস হলে CO₂ শোষণ কমে, বদলে যায় আবহাওয়ার চক্র।
ম্যানগ্রোভ ক্ষয়ের চিত্র আরও উদ্বেগজনক। পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনে কমেছে ২ বর্গকিলোমিটার ম্যানগ্রোভ, আর গুজরাতে ক্ষতি আরও তীব্র প্রায় ৩৬ বর্গকিলোমিটার। FSI-র ১৮তম ‘ইন্ডিয়া স্টেট অফ ফরেস্ট রিপোর্ট’ বলছে, সুন্দরবনের ১০২টি দ্বীপের মধ্যে ৫০টির বেশি জনবসতিপূর্ণ। WWFINCOIS-এর ২০২৫ সালের তথ্য অনুসারে, এর মধ্যে অন্তত চারটি দ্বীপ ইতিমধ্যেই পুরোপুরি ডুবে গেছে।
এই ধ্বংসযজ্ঞ কেবল পরিবেশ সংকট নয়, মানবজীবনের ওপরও সরাসরি আঘাত। হিসেব বলছে, চলতি ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের ১১৩টি উপকূলবর্তী শহর জলমগ্ন হওয়ার ঝুঁকিতে থাকবে। শুধু সুন্দরবনেই হারিয়ে যেতে পারে ১৫% দ্বীপ, ঝুঁকিতে ৪.৫ মিলিয়ন মানুষের ভবিষ্যৎ। গুজরাতের ভাবনগর উপকূল ৮৭ সেমি সমুদ্র বৃদ্ধিতে বিপন্ন হবে ১০ লক্ষ মানুষ। চেন্নাইয়ে বাড়বে বন্যা ও উপকূল ভাঙনের ঝুঁকি।বিপদে প্রায় ৭ মিলিয়ন নাগরিক।
মহারাষ্ট্রের মুম্বই প্রতি বছর ২ মিমি হারে ডুবে যাচ্ছে, যেখানে ঝুঁকিতে ২ কোটিরও বেশি মানুষ। কেরলের কোচি এই তালিকার মাঝেই রয়েছেপ্রভাব পড়বে কমপক্ষে পাঁচ লক্ষ মানুষের জীবনে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনই ব্যাপক পুনরুদ্ধার প্রকল্প শুরু না করলে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে। ম্যানগ্রোভ পুনর্জন্ম, সমুদ্র বাঁধ নির্মাণ, উপকূল রক্ষা পরিকল্পনা এবং এনডিএমএ–র ২০২৩ সালের অভিযোজন নীতি দ্রুত বাস্তবায়ন করা জরুরি। কারণ, এই সংকট কেবল পরিবেশ নয়, মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গেও সরাসরি জড়িত।