সমৃদ্ধ দত্ত, নয়াদিল্লি: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর ‘দাদা’ স্থানীয়! ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট অধরলাল সেন ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের একনিষ্ঠ ভক্ত। একদিন তাঁর শোভাবাজারের বাড়িতে গিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণদেব শুনতে পান, গৃহকর্তার কিছু বন্ধু এসেছেন তাঁকে দেখতে। প্রত্যেকে উচ্চপদাধিকারী। তাঁদেরই অন্যতম বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর পরিচয় করাতে গিয়ে অধরবাবু বলেন, ‘মহাশয়, ইনি ভারি পণ্ডিত, অনেক বই-টই লিখেছেন। আপনাকে দেখতে এসেছেন। ইঁহার নাম বঙ্কিমবাবু।’ শ্রীরামকৃষ্ণ সহাস্যে বলেছিলেন, ‘বঙ্কিম! তুমি আবার কার ভাবে বাঁকা গো!’ বঙ্কিমও হেসে বলেছিলেন, ‘আর মহাশয়, জুতোর চোটে! সাহেবের জুতোর চোটে বাঁকা।’
অর্থাৎ, রাশভারী ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে তাঁর বন্ধু ও সহকর্মীরাও ‘বঙ্কিমদা’ নামে সম্বোধন করতেন না। রবি ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, নবীনচন্দ্র সেন, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর লিখিত ভাষ্যে তেমন কিছু নেই। ‘বন্দেমাতরম’ রচনার দেড়শো বছর পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সেই সাহিত্যসম্রাটকে দফায় দফায় সম্বোধন করলেন, ‘বঙ্কিমদা’! তিনি আবার সর্বদা সুর বেঁধে দেন দলের নীতির। এদিনও তাঁর অন্যথা হয়নি। কেন্দ্রীয় সংস্কৃতিমন্ত্রী গজেন্দ্র সিং শেখাওয়াত তাই লোকসভায় নিজের ভাষণে সাহিত্যসম্রাটকে সম্বোধন করেন, ‘বঙ্কিম দাস চ্যাটার্জি’ নামে।
নাম ধরে সম্বোধন করতে অবশ্য মোদি পছন্দই করেন। এর আগে তাঁর মুখে শোনা গিয়েছে ‘মাই ফ্রেন্ড বারাক’, ‘মাই ফ্রেন্ড ডোনাল্ড’। তবে সোমবার খোদ লোকসভার মধ্যে পরাধীন ভারতের শ্রেষ্ঠ বিপ্লবমন্ত্র এবং স্বাধীন ভারতের জাতীয় গান ‘বন্দেমাতরম’ নিয়ে আলোচনায় মোদির মুখে ‘বঙ্কিমদা’ সম্বোধন প্রবল প্রতিবাদের সম্মুখীন হয়েছে। এক ঘণ্টার ভাষণে বারবার ‘বঙ্কিমদা’, ‘বঙ্কিমদা’ উচ্চারণ করায় তৃণমূল কংগ্রেসের সৌগত রায় একসময় বলে ওঠেন, ‘বঙ্কিমদা বলছেন কেন? বঙ্কিমবাবু বলা উচিত!’ মোদি রীতিমতো অপ্রতিভ হয়ে তৎক্ষণাৎ বলেন, ‘আচ্ছা আচ্ছা, বঙ্কিমবাবু! থ্যাংক ইউ... থ্যাংক ইউ!’ তবে প্রধানমন্ত্রী বিষয়টিকে হালকা করার চেষ্টায় এরপরই সৌগতবাবুকে বলেন, ‘আপনাকে দাদা বলতে পারি তো?’ কংগ্রেস থেকে তৃণমূল— বিরোধী মহাজোট ইন্ডিয়ার শরিক দলগুলি এর প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে। মোদির বিরুদ্ধে তোলা হয়েছে অপসংস্কৃতির অভিযোগ। তৃণমূল বলেছে, মোদিজি, একমাত্র ‘সাংস্কৃতিক অশিক্ষিত’ ছাড়া কেউ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো মহীরুহের নামের সঙ্গে ‘দাদা’ যুক্ত করবে না!
তবে শুধু ‘বঙ্কিমদা’তেই ক্ষান্ত হননি প্রধানমন্ত্রী। ‘বন্দেমাতরম’ বন্দনার ইতিহাস বিবরণে সেই জওহরলাল নেহরু ও কংগ্রেস বিরোধিতায় প্রবেশ করেছেন। এবং কংগ্রেসকে তোপ দাগতে গিয়ে পরোক্ষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও বিশ্বাসঘাতক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তা নিয়েও বিরোধীরা তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে। ‘বন্দেমাতরমে’র প্রথম দুই পংক্তিকেই ১৯৩৭ সালে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে জাতীয় গান হিসেবে সংযোজিত করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তা নিয়ে কটাক্ষ করে মোদির প্রশ্ন, ‘বন্দেমাতরমকে ব্যবচ্ছেদ করে এই গানের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা কারা করেছিল?’ এমনকি নেহরুকে নিশানা করে তিনি আরও বলেন, ‘মুসলিম লিগের চাপে এই সিদ্ধান্ত।’ রবি ঠাকুর যে এই সিদ্ধান্তের অঙ্গ ছিলেন, সেকথা একবারও উচ্চারণ করেননি প্রধানমন্ত্রী। আর তাই প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখা কবিগুরুর জীবনী উদ্ধৃত করে পরে কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ বলেন, ‘দুই পংক্তিকেই গ্রহণ করার সিদ্ধান্তকে পূর্ণাঙ্গ সমর্থন জানিয়ে সুভাষজি ও নেহরুজিকে চিঠি লিখে তার কারণ বিশ্লেষণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বিশ্বাসঘাতক আখ্যা দিয়ে তাঁকেও অপমান করলেন মোদি।’ প্রধানমন্ত্রীর ভ্রান্তিবিলাস অবশ্য এরপরও বজায় ছিল। মাস্টারদা নয়, সূর্য সেনকে সম্বোধন করলেন তিনি ‘মাস্টার সূর্য সেন’! যেখানে দাদা দরকার ছিল, সেখানে দাদা বাদ! তারপর আবার বন্দেমাতরমের সঙ্গে মোদি এদিন সম্পৃক্ত করেন রামচন্দ্রের উক্তি, ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী’কে। ‘বন্দেমাতরম’কে হিন্দুত্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার চেষ্টায় প্রধানমন্ত্রী এও স্মরণ করিয়ে দেন যে, ব্রিটিশের একটি ফ্যাশন ছিল ভারতকে দুর্বল দেখানো। সেই সময় ‘বঙ্কিমদা’ এই গানের মধ্যেই লিখেছিলেন, ‘ত্বং হি দুর্গা দশপ্রহরণধারিণী/কমলা কমল-দলবিহারিণী...’। মোদির ক্ষোভ, এই পংক্তিগুলি বাদ দেওয়া হয়েছিল কেন? মহাত্মা গান্ধীই যে এই গানের প্রথম দুই পংক্তির প্রাথমিক প্রস্তাবক, সেকথাও এড়িয়ে গিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বিরোধীদের প্রশ্ন, বন্দেমাতরম নিয়ে মোদিজি একবারও আরএসএসের নামোচ্চারণ করলেন না কেন? তাহলে কি তিনি স্বীকার করলেন, বন্দেমাতরমের সঙ্গে আরএসএসের কোনও সম্পর্কই নেই!