এই সময়: ঠিক একমাসের মাথায় দ্বিতীয়বার। ‘বন্দে মাতরম’–এর সার্ধ–শতবর্ষ অনুষ্ঠানের সূচনালগ্নেই গত ৭ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বক্তব্য ঘিরে শুরু হয়েছিল বিতর্ক। সোমবার সেই বিতর্ক তুঙ্গে উঠল সংসদে। ‘বন্দে মাতরম’ নিয়ে সংসদের দুই কক্ষে ১০ ঘণ্টা করে আলোচনা এ দিন শুরু করেন নমোই। সেই আলোচনায় তিনি বেঁধেন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু থেকে শুরু করে গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টিকে। মোদীকে পাল্টা দিতে দেরি করেনি কংগ্রেসও।
দেশে তখন ব্রিটিশ রাজ। ১৯৩৫-এ ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাশ ‘ভারত শাসন আইন’ কার্যকর হয় ১৯৩৭–এ। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বন্দে মাতরম’ তখন হয়ে উঠেছে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বীজমন্ত্র। সেই গানেরই প্রথম দু’টি স্তবককে দেশের ‘জাতীয় গীত/গান’ (ন্যাশনাল সং) হিসেবে ১৯৩৭-এ কংগ্রেসের অধিবেশনে গাওয়া হয়েছিল, যা পরবর্তীতে সংবিধান সভায় ‘জাতীয় গান’ হিসেবে মান্যতা পায়। সেই গান রচনার ১৫০ বছরে দেশ ফের নতুন করে সরগরম।
এ দিন লোকসভায় মোদী বলেন, ‘কংগ্রেস তখন থেকেই তোষণের রাজনীতি করে আসছে। মুসলিম লিগের সামনে মাথা নত করেছিল তারা।’ তাঁর দাবি, ‘বন্দে মাতরমের তীব্র বিরোধী ছিলেন মহম্মদ আলি জিন্না। তাঁর সঙ্গে সহমত পোষণ করেছিলেন জওহরলাল নেহরুও। এমনকী নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে একটি চিঠি লিখে নেহরু বলেছিলেন, বন্দে মাতরম মুসলিমদের প্ররোচিত করতে পারে!’ নমোর তোপ, নেহরুর এমন বয়ান আসলে ‘বন্দে মাতরমের’ সঙ্গে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’। তাঁর সংযোজন, ‘ইংরেজরা জানত, বাংলা ভাগ হলে আন্দোলনও ভেঙে যাবে। তাই বাংলাতেই প্রথম বিভাজনের রাজনীতি শুরু করেছিল! বঙ্কিমও তার জবাব দিয়েছিলেন।’ যদিও ইতিহাস বলছে, ১৮৯৪–এ বঙ্কিম মারা যান আর ব্রিটিশদের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ ১৯০৫–এ রবার্ট ক্লাইভের ‘বঙ্গভঙ্গের’ মাধ্যমে শুরু হয়েছিল!
বস্তুত, বাংলা ও বাঙালি এবং ভোটার তালিকায় স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশনের আবহে আগামী বছর বাংলায় বিধানসভা নির্বাচনের আগে মোদীর এ দিনের বক্তব্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাঁদের যুক্তি, ভোটের মাথায় রেখেই সম্ভবত মোদী সুকৌশলে এ দিন মাস্টারদা সূর্য সেন থেকে ক্ষুদিরাম বসু— বাংলার অন্য স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রসঙ্গও সংসদে তুলেছেন, যাতে ‘বাঙালি–বিদ্বেষী’ তকমা মুছে ফেলা যায়। সেই কারণে কংগ্রেস সাংসদ প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর স্পষ্ট মন্তব্য, ‘বন্দে মাতরম নিয়ে সরকার সংসদে আলোচনা করছে, কারণ, সামনে বাংলায় বিধানসভা নির্বাচন। তাই দেশের মূল বিষয়গুলি ও নিজেদের ব্যর্থতা থেকে সাধারণ মানুষের নজর ঘোরাতে তৎপর কেন্দ্র।’ প্রত্যাশিত ভাবে নমোকে নিশানা করেছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। উত্তরবঙ্গ যাওয়ার পথে কলকাতা বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘বন্দে মাতরমের পুরো গান নেওয়া হয়নি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিছু নির্দিষ্ট লাইন নিয়েছিলেন। তার ভিত্তিতে এটি জাতীয় গীত হয়েছে।’ তাঁর সংযোজন, ‘এরা নেতাজিকে অপমান করে, বঙ্কিমচন্দ্রকে অপমান করে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অপমান করে, বিদ্যাসাগরকে অপমান করে, রাজা রামমোহন রায়কে অপমান করে, এরা জানে বাংলার অবদান? এরা (বিজেপি নেতৃত্ব) দেশের কিছুই জানে না।’
রাজনৈতিক মহলের একাংশের মতে, বঙ্কিমের কালজয়ী সৃষ্টির প্রথম দু’টো স্তবক বাদে পুরোটাই হিন্দু দেবদেবী ও ধর্মের বন্দনা। তাই কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ‘মুসলিম তোষণ’-এর অভিযোগ এনে হিন্দু ভোট একত্রিত করার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে বিজেপি। পাশাপাশি, বাংলার তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধেও সংখ্যালঘু তোষণের অভিযোগে সরব গেরুয়া শিবির। তাই ‘মুসলিমদের সামনে মাথা নত করে নেহরু বাঙালি ঔপন্যাসিক ও সংখ্যাগুরু হিন্দুদের সঙ্গে প্রতারণা’ করেছেন — এমন তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টার ত্রুটি রাখছে না সরকার। তবে সংসদে ‘বন্দে মাতরম’ বিতর্কে শাণ দিয়ে পদ্মের বঙ্গ–বিজয়ের পথ আদৌ প্রশস্ত হবে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান বিজেপিরই অনেকে।
প্রিয়াঙ্কা বলেন, ‘আমরা এই প্রসঙ্গে তর্ক-বিতর্ক কেন করছি? এটা তো আমাদের জাতীয় গান। আসলে বাস্তব সব সমস্যাকে এড়িয়ে গিয়ে শুধু বাংলাকে টার্গেট করেই এই প্রসঙ্গে কথা বলছে কেন্দ্র। আমি নিশ্চিত, সামনেই বাংলায় নির্বাচন। তাই অতীতকে আঁকড়ে ধরে তা নিয়ে সংসদে আলোচনা হচ্ছে।’
এ দিন লোকসভায় আলোচনার শুরু থেকে মোদী লাগাতার নেহরুকেই নিশানা করেন। তাঁর কথায়, ‘বন্দে মাতরমের ঐতিহ্যকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। কংগ্রেস মুসলিম লিগের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। নেহরু এই গানকে টুকরে-টুকরে করেছিলেন।’ তাঁর দাবি, প্রথমে বন্দে মাতরমকে ভাগ করা হয়, তার পরে দেশকে! সবই নেহরুর ‘আত্মসমর্পণের’ জন্য।
পাল্টা প্রিয়াঙ্কার যুক্তি, ‘বন্দে মাতরমের দু’টি স্তবক গ্রহণ ও পরেরগুলি বাদ দেওয়া নিয়ে অযথা সাম্প্রদায়িক রং চড়ানো হচ্ছে। বাবাসাহেব আম্বেদকর থেকে শুরু করে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, সকলেই তো এই গানের প্রথম দু’টি স্তবকেই সম্মতি দিয়েছিলেন।’ তাঁর প্রশ্ন, ‘প্রধানমন্ত্রী নেহরুর চিঠি পড়লেন, জবাবে নেতাজি কী বলেছিলেন তা কেন পড়ে শোনালেন না? নেতাজি তো গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরামর্শ করার কথাও উল্লেখ করেছিলেন। আবার গুরুদেবও জানিয়েছিলেন, বন্দে মাতরমের প্রথম দুটো স্তবকের সঙ্গে আনন্দমঠে থাকা অংশের সংযোগ তেমন ভাবে নেই। তাই সেটি আলাদা করে গ্রহণ করা যেতেই পারে।’
কংগ্রেস সাংসদ গৌরব গগৈয়ের ব্যাখ্যা, ‘মুসলিম লিগ চেয়েছিল, বন্দে মাতরম বাতিল হয়ে যাক। কিন্তু কংগ্রেস কি মুসলিম লিগের কথায় চলবে? মৌলানা আজ়াদ সেই সময়ে বলেছিলেন, বন্দে মাতরমে তাঁর আপত্তি নেই। এটাই ফারাক কংগ্রেস আর মুসলিম লিগের মধ্যে।’ নাম না করে আরএসএস-কেও বিঁধেছেন তিনি। গৌরবের কথায়, ‘আপনাদের রাজনৈতিক পূর্বসূরিরা কি স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন? তাঁদের ভূমিকাটাও একটু বলুন না।’ প্রিয়াঙ্কাও বলেন, ‘বিজেপি ও সরকার দু’টি অঙ্ক বিবেচনায় রেখে এ নিয়ে আলোচনায় আগ্রহী। প্রথমত, স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে হেয় করা। দ্বিতীয়ত, নিজেদের স্বাধীনতা সংগ্রামী প্রমাণ করা।’ যদিও প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং লোকসভায় বিতর্কের শেষে বলেন, ‘বন্দে মাতরম কেবল বাংলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এটি উত্তর থেকে দক্ষিণে, পূর্ব থেকে পশ্চিমে সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই গান দেশের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সঙ্গে যুক্ত।
এ দিন শুধু নেহরু নন, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকেও নিশানা করেছেন মোদী। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘১৯৭৫-এ বন্দে মাতরমের ১০০ বছর পূর্তিতে সংবিধানকে রুদ্ধ করা হয়েছিল।’ দামোদর বিনায়ক সাভারকরের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীর দাবি, ‘তিনি লন্ডনে বসে এই গান গেয়েছিলেন। কী ভাবে তা আমাদের স্বাধীনতার লড়াইকে অনুপ্রেরণা দিয়েছিল, সে কথা দেশবাসীকে জানেন।’
কিন্তু সংসদে ‘বন্দে মাতরম’ নিয়ে এই বিতর্কের সঙ্গে কি ইতিহাসের মিল আছে?
ইতিহাসবিদদের অনেকেই এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করছেন সব্যসাচী ভট্টাচার্যের বই — ‘বন্দে মাতরম– দ্য বায়োগ্রাফি অফ আ সং’-এর কথা। তিনি সেখানে লিখেছিলেন, ১৯৩৭–এ কলকাতা কংগ্রেসের আগে নেহরু ‘বন্দে মাতরম’ গানটি ন্যাশনাল অ্যান্থেম হিসেবে নেওয়া ঠিক হবে কি না, তা নিয়ে সুভাষচন্দ্র বসুর কাছে জানতে চেয়েছিলেন। তিনি নেহরুকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা করতে বলেন। নেহরুর চিঠির প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, ‘গানটির শুরুতে দেশ–মায়ের যে বন্দনা করা হয়েছে তার মধ্যে একটা বিশেষ আর্তি আছে... ফলে আমি এই অংশটিকে বাকি কবিতা ও বই (আনন্দমঠ)–এর থেকে আলাদা করে দেখতেও রাজি আছি...।’ এই চিঠিরই পরবর্তী অংশে তিনি লিখেছেন, ‘আমি মেনে নিচ্ছি যে বন্দে মাতরমকে যদি তার সম্পূর্ণ কনটেক্সটে দেখা হয়, তা হলে তা হয়তো মুসলিমদের মতাদর্শকে আঘাত করতে পারে... তবে সব সময়ে তো গানটি গাওয়ার সময়ে তার সম্পূর্ণতা দিয়ে বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই... প্রথম দু’টি স্তবক নিজেই তার আলাদা তাৎপর্য তৈরি করেছে... তা কোনও সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীকে আঘাত করবে বলে আমি মনে করি না।’ দীর্ঘ আলাপ–আলোচনার পরে ১৯৩৭–এ এআইসিসি–র অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথের ব্যাখ্যাকে মান্যতা দিয়েই এটিকে ‘জাতীয় গান’ হিসেবে গ্রহণ করা হয়।