• ‘ক্লান্তিতে ককপিটে চোখটা বুজে আসে’, তিন বছর আগের সমীক্ষা, কাঠগড়ায় DGCA
    এই সময় | ১০ ডিসেম্বর ২০২৫
  • সুনন্দ ঘোষ

    ভোর ছ’টায় ফ্লাইট। সাড়ে চারটে থেকে পৌনে পাঁচটার মধ্যে ঢুকতেই হবে এয়ারপোর্টে। ফ্লাইট ডেসপ্যাচে গিয়ে হাজারো কাজ থাকে। তারপরে ককপিটে খুঁটিনাটি চেকিং।

    বাড়ি থেকে অন্তত চারটের মধ্যে বেরোতে হয়। সেটাও নির্ভর করে বাড়ি থেকে এয়ারপোর্ট কত দূর, তার উপরে। ফলে, রাত তিনটে নাগাদ কানের পাশে মোবাইলে সেট করা অ্যালার্ম কর্কশ কণ্ঠে বেজে ওঠে। স্নান–টান সেরে রেডি হয়ে বেরোতেও কিছুক্ষণ সময় লাগে।

    সকাল ছ’টার ফ্লাইট দিয়ে শুরু। দেশের এক শহর থেকে অন্য শহরে উড়ে যাওয়া। চারটে ল্যান্ডিং শেষ করতে করতে প্রায় ১২ ঘণ্টা পেরিয়ে যায়। প্রতিবার অন্য শহরে নেমে আবার ডেসপ্যাচ, আবার হাজারো কাজ। কফি–টেবিলের ও পারে বসে কম্যান্ডার পাইলটের অভিযোগ, ‘ভোর চারটেয় বাড়ি থেকে বেরিয়ে ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় আটটা। আবার স্নান, ডিনার শেষ করে ঘুম। আবার তো রাত তিনটেয় অ্যালার্ম বাজবে। কী ভাবছেন? রাতে দু’পেগ মেরে দিলে ভালো ঘুম হবে? উপায় নেই। কারণ, প্রতিটি ফ্লাইটের আগে ব্রেদালাইজ়ার টেস্ট রয়েছে। এরপরেও ক্লান্তি আসবে না বলছেন?’

    রস্টার অনুযায়ী, কোনও কোনও দিন বাড়ি ফেরাও হয় না। অন্য শহরের হোটেলের বিছানায় এলিয়ে দিতে হয় গা। রুটিনের হেরফের হয় না। শুধু বদলে যায় বিছানা। কম্যান্ডার বলছেন, ‘এখনও তো ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটের হিসেব দিইনি। দিল্লি–সিঙ্গাপুর–দিল্লি দু’টো ল্যান্ডিং। কিন্তু, সেটা শেষ করতে ১৫ থেকে ১৬ ঘণ্টাও লেগে যায়।’ সপ্তাহে এ ভাবে সাড়ে পাঁচদিন ডিউটি করলে দেড় দিনের ছুটি। তাতেও হাজারো রেস্ট্রিকশন। ফ্লাইটের ১২–১৪ ঘণ্টা আগে নো–অ্যালকোহল।

    পাইলটদের এই দুর্বিষহ রুটিন এবং তার ফলে ক্লান্তির কথা উঠে এসেছিল ২০২২–এর একটি সার্ভে–তে। ভারতে ‘সেফটি ম্যাটার্স ফাউন্ডেশন’ নামে একটি সংস্থা (যারা দীর্ঘদিন ধরে পাইলটদের ক্লান্তি, যাত্রীদের নিরাপত্তা–সহ বিমান পরিবহণের বহু দিক নিয়ে কাজ করছে)–র করা এই সার্ভে–তে ভয়ানক সব তথ্য উঠে এসেছিল। সার্ভে–তে অংশ নেওয়া পাইলটদের ৬৬ শতাংশ জানিয়েছিলেন, এই ভয়ঙ্কর রুটিনের ফলে মাঝ আকাশে ককপিটের মধ্যেই চোখ লেগে যায় তাঁদের। আবার ধড়মড়িয়ে জেগে ওঠেন। ৩১ শতাংশ পাইলট স্বীকার করে নিয়েছিলেন, এ ভাবে মাঝ আকাশে বা টেক–অফ অথবা ল্যান্ডিংয়ের সময়ে অনেক ছোটখাটো অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা তৈরি হয়। আর ৭৩ শতাংশ পাইলট জানিয়েছিলেন ক্লান্তির মূল কারণই ‘আর্লি মর্নিং ফ্লাইট’।

    সার্ভে–তে অংশ নিয়েছিলেন দেশের সমস্ত এয়ারলাইন্সের পাইলট। সেই রিপোর্ট সামনে আসার পরে একটা মোদ্দা বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায়, পাইলটদের আরও বিশ্রামের প্রয়োজন। পাইলট সংগঠনের সেই দাবি বিমান মন্ত্রক ও নিয়ন্ত্রক ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ সিভিল এভিয়েশন (ডিজিসিএ)–এর কাছে পৌঁছয়। এয়ারলাইন্সের আপত্তি সত্ত্বেও তাই পাইলটদের বিশ্রামের সময় বাড়িয়ে এ বছরের ১ নভেম্বর থেকে নতুন ফ্লাইট ডিউটি টাইম লিমিটেশন (এফডিটিএল) চালু করে ডিজিসিএ।

    পাইলটরা নতুন নিয়মে খুশি ছিলেন। ২ ডিসেম্বর থেকে ইন্ডিগোর ফ্লাইট বাতিল হতে শুরু করে। দায়ী করা হয় নতুন এফডিটিএল–কেই। ৫ ডিসেম্বর এক হাজার ফ্লাইট ক্যান্সেলড হতে চাপে পড়ে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে ডিজিসিএ নতুন নিয়ম তুলে নেয়। ফলে, এই মুহূর্তে পুরোনো নিয়মই চলছে।

    পাইলটদের বড় অংশের প্রশ্ন, ডিজিসিএ কী করছিল? তাঁদের কথায়, দিল্লি হাইকোর্ট তো ডিজিসিএ–কে নতুন নিয়ম নিয়ে হলফনামা জমা দিতে বলেছিল। পাইলটদের বেশি বিশ্রাম দিতে শুরু করলে ইন্ডিগো এত ফ্লাইট চালাতে পারবে কিনা, তা তখন ডিজিসিএ দেখেনি কেন? পাইলটদের দাবি, ১ নভেম্বর শীতকালীন উড়ানসূচি লাগু হওয়ার অন্তত এক মাস আগে সমস্ত এয়ারলাইন্স তাদের শিডিউল জমা দিয়েছিল। ইন্ডিগোও দিয়েছিল। তাদের কাছে কত পাইলট বা কেবিন ক্রু আছে, তা তো ডিজিসিএ–র জানার কথা। সেই লোকবল নিয়ে নতুন এফডিটিএল–এ এই শিডিউল যে তারা চালাতে পারবে না, সে কথা তো ডিজিসিএ–র বোঝার কথা ছিল। তখন কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি?

    নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, ডিজিসিএ–র এক কর্তার প্রত্যুত্তর, ‘প্রথমত, প্রায় প্রতিদিনই ইন্ডিগোর মতো এয়ারলাইন্সের রিক্রুটমেন্ট প্রসেস চলে। আমাদের অত ট্র্যাক রাখা মুশকিল। দুই, সমস্যা তো অন্য এয়ারলাইন্সের হলো না? নতুন এফডিটিএল–এই যদি সমস্যা হতো, তা হলে তো ১ নভেম্বর তা চালু হওয়ার পরেই হতো। কেন ডিসেম্বরের গোড়ায় হলো? কেন এমন সময় হলো, যখন রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট পুতিনের মতো বিদেশি অতিথি দেশে? পুরোদস্তুর সংসদ চলছে?’ ওই কর্তার কথায়, এ সবই পরিকল্পনা মাফিক কি না, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। আপাতত উইন্টার শিডিউল ১০ শতাংশ কমিয়ে ডানা ছাঁটা হচ্ছে ইন্ডিগোর।

    ক্লান্তি নিয়ে সার্ভে–কে পাইলটদের বক্তব্য

    ৭৩% — ক্লান্তির মূল কারণ মর্নিং ফ্লাইট

    ৬৬% — নিজের অজান্তেই ককপিটে লেগে যাচ্ছে চোখ

    ৩১% — ক্লান্তির কারণে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে

    ৪৩% — পরের দিনের ফ্লাইটে যেতে ইচ্ছে করে না

    ৭১% — এই ক্লান্তি নিয়ে পরের দিন ফ্লাইটে যাওয়া উচিত নয়

    ৫৪% — এই ক্লান্তির কথা ম্যানেজমেন্টকে জানানো হয়েছে

    ৬৯% — ক্লান্তি দূর করতে এয়ারলাইন্সের কোনও উদ্যোগই নেই

    ৯৭% — ডিজিসিএ চোখ বন্ধ করে রয়েছে

  • Link to this news (এই সময়)