সন্তানের পড়াশোনায় হাত ধরতে মাদুরদহের স্কুলে মা-ঠাকুরমারাও
আনন্দবাজার | ১০ ডিসেম্বর ২০২৫
শ্রেণিকক্ষে বসে আছে পড়ুয়ারা। পিছনে তাদের অভিভাবকেরাও। পড়ুয়ারা এক মনে শুনছে তাদের শিক্ষিকার কথা। প্রয়োজনে নোট নিচ্ছে। খুদে পড়ুয়াদের অভিভাবকেরাও শুনছেন শিক্ষিকার পড়ানো।
ছাত্র এবং অভিভাবকেরা একসঙ্গে এই ক্লাস করছেন আনন্দপুরের মাদুরদহ এলাকার মাদুরদহ সত্যবৃত্তি বিদ্যালয়ে। একসঙ্গে ক্লাস করলেও অভিভাবকেরা অবশ্য পরীক্ষায় বসবেন না। তাঁরা ক্লাসে এসেছেন, কারণ, বাড়ি গিয়ে তাঁরা ছেলেমেয়েদের পড়াশোনায় সাহায্য করতে চান। পড়াশোনায় ছেলেমেয়েদের আরও বেশি উৎসাহিত করতে এবং প্রয়োজনে পরামর্শ দিতে অভিভাবকেরা তাদের সঙ্গেই ক্লাসে বসে রয়েছেন।
মাদুরদহের এই স্কুলের পড়ুয়ারা বেশির ভাগই এসেছে আর্থিক ভাবে দুর্বল পরিবার থেকে। তাদের মায়েরা কেউ গৃহবধূ, কেউ বা কোনও বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করেন, কেউ দোকান চালান। তাঁরা পড়াশোনায় অনেকেই হয়তো স্কুলের গণ্ডি পেরোননি। কিন্তু তাঁরা চান, ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা শিখে নিজেদের পায়ে দাঁড়াক। সেই কাজে সহায়তা করতেই ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা নিবিড় ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন তাঁরা।
মঙ্গলবার হচ্ছিল কোডিং শেখার ক্লাস। ক্লাস নিচ্ছিলেন সুতনুকা রায়। সুতনুকা বলেন, “অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ুয়ারা এই ক্লাস করছে গত কত কয়েক দিন ধরে। কোডিং শিখে অনেকে মাল্টিমিডিয়ায় অ্যানিমেশনের মাধ্যমে ছোট ছোট গল্প বানাতে পারছে। কেউ বা কোডিংয়ের মাধ্যমে ছোট কম্পিউটার গেম তৈরি করতে শিখেছে। দেখছি, ক্লাসে ওদের মায়েদেরও খুব উৎসাহ। ছেলেমেয়েরা শিখছে, তাই মা-বাবারাও কিছুটা বোঝার চেষ্টা করছেন, এটাই বা ক’জন করেন?’’
এই স্কুল যাঁরা চালান, সেই দক্ষিণী প্রয়াসের কর্ণধার কমল প্রকাশ বলেন, “এই স্কুল যখন তৈরি হয়েছিল, তখন আমাদের লক্ষ্য শুধু আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া ছেলেমেয়েদের পড়াশোনায় ভাল করাই ছিল না। ওরা যে পরিবেশে এখন থাকে, ভবিষ্যতে যাতে তার চেয়ে আর্থিক ও সামাজিক ভাবে উন্নততর পরিবেশেথাকতে পারে, সেটা দেখাও লক্ষ্য ছিল। পরিবারের সার্বিক উন্নতিই আমাদের পাখির চোখ। মায়েরা অনেকে নিজেদের কাজ ফেলেও বাচ্চাদের সঙ্গে এখানে এসে ক্লাস করেন।’’ স্কুলের পরিচালন সমিতির সদস্যরবীন্দ্রনাথ মিশ্র বলেন, ‘‘আমাদের স্কুল থেকে প্রচুর ছেলেমেয়ে নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়ে তাদের পরিবারকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। জীবনযাত্রারসার্বিক মান উন্নত করেছে।’’ স্কুলের অধ্যক্ষা মিতা মিত্র বলেন, “স্কুল যখন শুরু হয়েছিল, তখন কিন্তু এত অভিভাবক আসতেন না।যত দিন যাচ্ছে, অভিভাবকদের সংখ্যা বাড়ছে।”
মঙ্গলবার কোডিং ক্লাসে তাঁদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বসে ছিলেন দুই অভিভাবক, রেখা মিস্ত্রি এবং দোলন জেলে। রেখা ও দোলন বলেন, “আমরা খুব বেশি পড়াশোনা করিনি। এখন নতুন করে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে অনেক কিছু শিখছি। ওদের পড়ার সময়ে সাহায্য করতে পারছি। বাড়ি গিয়ে ওদের সঙ্গে পড়াশোনা নিয়ে আলোচনা করতে পারি এখন।”
ক্লাস করার পরে শুভদীপ মণ্ডল, সূর্য চক্রবর্তী, রিমা বারুই, সোনালি মণ্ডলেরা জানায়, কোডিং ক্লাস থেকে কার্টুন চরিত্র তৈরি করে ছোট ছোট গল্প তারা বানাতে শিখেছে। সেগুলি তৈরি করে প্রথমে তারা মা-বাবাকেই দেখায়। মা-ও মাঝেমধ্যে নানা ধরনের পরামর্শ দেন। মায়েদের স্কুলে আসা যে তাদের জন্য উপকারী হয়েছে, সেটা এক বাক্যে জানাচ্ছে পড়ুয়ারা।
শুধু মায়েরাই নন, ক্লাসে দেখা গেল এক ঠাকুরমাকেও। পড়ুয়া উপাসনা দাসের সঙ্গে এসেছেন ঠাকুরমা অরুণা দাস। অরুণা বলেন, “নাতনি যেন গর্ব করার মতো পড়াশোনা শিখতে পারে ও নিজের পায়ে দাঁড়ায়,তাই ওকে সব সময়ে উৎসাহ দিই। ওর সঙ্গে ক্লাসেও আসি। আমি কম্পিউটারের কোডিং কিছু বুঝি না। তবে ক্লাসে নাতনি যা শিখছে, তা মন দিয়ে দেখলে ওকে কিছু পরামর্শ তো দিতে পারি।”