বাপ্পাদিত্য রায়চৌধুরী, কলকাতা: হরিদাসের বুলবুলভাজা, টাটকা তাজা খেতে মজা...এই ভাজাটি কি এমন বস্তু যে রানি ভিক্টোরিয়ার হুকুমে লন্ডনে গিয়েছিল। সেটি কি বাঙালির চানাচুর? এমন একটি ইঙ্গিত শংকর দিয়েছিলেন ব্যান্ডোদাকে। আসলে বুলবুল ভাজার আড়ালে বাঙালির জিভে জল আনা চিরন্তন জলখাবার ‘চানাচুর’ই লুকিয়ে বলে মনে করে অনেকে। ভারতজুড়ে যে ‘ভুজিয়া’র এত রমরমা, তার থেকে সরে এসে নিজেকে একেবারে আলাদা বেদীতে ঠাঁই করে নিয়েছে বাংলার চানাচুর। ডালভাজা, ঝুরিভাজা, পাপড়ি, বাদাম আর মশলার মিশেলে বৈচিত্র আছে ঠিকই। কিন্তু আসল কথা ওই টক ঝাল নোনতা। যা আসলে বাঙালির নিজের সম্পদ। অন্য কোনও প্রদেশের ‘মিক্স’ বা ‘স্ন্যাক্স’ এর স্বাদের থেকে এর অবস্থান বহু যোজন দূরে। চানাচুরের সেই নিজস্ব স্বাদেরই সত্ত্ব নিতে চাইছে পশ্চিমবঙ্গ। বাংলার চানাচুরের স্বীকৃতি পেতে জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশনস বা জিআই’এর রেজিস্ট্রির জন্য আবেদন জানিয়েছে। সেই আবেদন স্বীকৃত হয়েছে সম্প্রতি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ন’দিদি স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যা সরলাদেবী আত্মকথা ‘জীবনের ঝরাপাতা’য় নিজের জন্মবৃত্তান্ত তুলে ধরেছিলেন। জানিয়েছিলেন, তাঁর জন্মের পর আঁতুরঘরকে ঘিরে ব্রাহ্মধর্ম মেনে যেমন উপাসনা হয় তেমনই ঠাকুরবাড়িজুড়ে ‘আট কৌড়ে’ উপাচারও হয়েছিল। ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন প্রতিষ্ঠান কেসি দাশের কর্ণধার ও মিষ্টান্ন ও নোনতা ব্যবসায়ীদের সংগঠন ‘মিষ্টি উদ্যোগ’ এর সভাপতি ধীমান দাশ বলেন, ‘আট ভাজার উপাচারকেই তুলে ধরেছেন সরলাদেবী। আট রকমের ভাজাভুজি একত্র করা তো আসলে চানাচুরেরই আদি রূপ।’ সরলাদেবীর আত্মজীবনী ১৮৭৯ সালে সরস্বতী প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। চানাচুরের সঙ্গে প্রাচীন বাংলার নিবিড় যোগের কথা রয়েছে এই আত্মকাহিনিতে। প্রসঙ্গত চানাচুরের জিআইয়ের আবেদন করেছে মিষ্টি উদ্যোগ। এই সংগঠনে আছে চানাচুর প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানও।
কোনও পণ্যের জিআই স্বীকৃতি তখনই পাওয়া যায়, যখন প্রমাণিত হয় পণ্যটি কোনও নির্দিষ্ট স্থান বা এলাকার নিজস্ব ও আদি সম্পদ। চানাচুর যে বাংলারই, তার প্রমাণ করার দায়িত্ব এ রাজ্যেরই। তার জন্য বিভিন্ন নথি জিআই রেজিস্ট্রিতে ইতিমধ্যেই জমা পড়েছে। তালিকায় আছে অরুণকুমার মিত্র সম্পাদিত ‘অমৃতলাল বসুর স্মৃতি ও আত্মস্মৃতি’। ১৯৫৭ সালে লেখা সেই বইতে উল্লেখ, পাড়ার রাস্তা দিয়ে চানাচুরওয়ালার হেঁকে যাওয়ার কথা। ‘রসবতী’তে সাহিত্যিক শংকর চানাচুরের বাঙালিয়ানা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা তুলে ধরেছেন। প্রসঙ্গত ভারতবিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের প্রাণপুরুষ হলদিরাম আগরওয়াল ১৯৪৭ সালে কলকাতায় আসেন এক বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। তারপর শহরের প্রেমে পড়ে ব্রিজলাল স্ট্রিটে ৫০০ টাকা দিয়ে দোকান কেনেন। ব্যবসার গোড়াপত্তন করেন। অর্থাৎ চানাচুরের আমোঘ আকর্ষণ অস্বীকার করতে পারেননি তাঁরাও। আসলে, ডালমুঠের স্বাদ টপকে এগিয়ে গিয়ে চানাচুরকে বহু বছর ধরে আপন করে পথ চলছে বাঙালি। এবার সময় স্বীকৃতি প্রাপ্তির।