• স্যার, আপনি এই গাঁয়ে এসেই মরবা, খুদের আবদারে চোখে জল বিদায়ী শিক্ষকের
    বর্তমান | ১১ ডিসেম্বর ২০২৫
  • পিনাকী ধোলে, সিউড়ি: ‘স্যার, আপনি কিন্তু এই গাঁয়ে এসেই মরবা। আপনাকে আমি খুউব ভালোবাসি...।’ বিদায়ের দিনে কচি মুখে এমন আবদার শুনে হতবাক শিক্ষক! ধরে রাখতে পারলেন না চোখের জল। কান্না-ভেজা গলায় আশ্বস্ত করলেন শুধু এই বলে—‘তোদের ভালোবাসার টানেই হয়তো আমার মরণ হবে এই গ্রামে। আজ তা হলে যাই।’ হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল ঋত্বিকা দাস।

    লাভপুরের শীতলগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির পড়ুয়া ঋত্বিকা।  ওই স্কুলেই পড়াতেন সদ্য প্রাক্তন শিক্ষক রিপনকান্তি বালা। স্কুলে আসার পর থেকেই পড়ুয়াদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন তিনি। ছাত্র- ছাত্রীদের সঙ্গে নিবিড় এক সম্পর্কে বাঁধা পড়েছিলেন। সেই সম্পর্ক ছিন্ন করতে নিজেও চাইছিলেন না। কিন্তু, সময়ের নিষ্ঠুরতার কাছে হার মানতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু, ছোট্ট ঋত্বিকার কথা শক্তিশেলের মতো হৃদয়ে গেঁথে রেখেও ছড়িয়ে দিয়েছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। রিপনবাবু নিজেও বলছেন, ‘ঋত্বিকার কথা আমৃত্যু আমার বুকে হাতুড়ি পেটাবে। স্কুল ছেড়ে যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না। বাবা-মায়ের শারীরিক অবস্থা ভালো নয়। আমি একমাত্র ছেলে। বাড়ির কাছাকাছি বদলি নিতেই হল।’ 

    ২০২১ সালে শীতলগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন বছর ছত্রিশের রিপনবাবু। দীর্ঘ প্রায় চার বছর কাটিয়ে সম্প্রতি রিপনবাবু বদলি হয়ে গিয়েছেন দক্ষিণ দমদমের প্রফুল্ল বিদ্যামন্দির স্কুলে। তাঁর বাড়ি উত্তর ২৪ পরগনার হাবরার রুদ্রপুর গ্রামে। শীতলগ্রাম থেকে যার দূরত্ব প্রায় ২০০ কিলোমিটারের বেশি। বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা-মা। বাবার একাধিকবার ব্রেন স্ট্রোক হয়েছে। মায়ের হার্টে পেশ মেকার বসানো। একদিকে, বাবা-মায়ের প্রতি দায়িত্ববোধ। অন্যদিকে, স্কুল পড়ুয়াদের প্রতি প্রেম। বেশ উভয়সঙ্কটেই পড়েছিলেন রিপনবাবু। অনেক ভেবেচিন্তে এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয় তাঁকে। বিদায়ের দিনে খুদে ঋত্বিকার আবদার কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছে তাঁর হৃদয়কে।  

    শীতলগ্রামের অভিভাবকরাও বলছেন, বর্তমান শিক্ষা সমাজের এই ক্রান্তিকালে রিপনবাবু ছিলেন আদর্শ  শিক্ষক। আমাদের ছেলে-মেয়েদের বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। শৈশব গড়তে প্রধান শর্ত শিশুমনকে বোঝা। এটা উনি ভালোই জানতেন। তাই ক্লাসে অমনোযোগী পড়ুয়াকে বাইকে করে ঘুরিয়ে নিয়ে এসে ফের পড়তে বসিয়েছেন। অঙ্ক বুঝিয়েছেন খেলার ছলে। যে পড়ুয়া স্কুলে না এসে পাড়ায় টো টো করে ঘুরে বেড়াত, তাকেও স্কুলে আসার নেশা ধরিয়েছেন। নিজের টাকায় কিনে দিয়েছেন ব্যাট-বল। স্কুলের শেষে পড়ুয়াদের সঙ্গে ঝালমুড়ি উত্সবের ফাঁকে শিখিয়েছেন গান, কবিতা আবৃত্তি। প্রত্যন্ত গ্রামের একটি স্কুলকে আর পাঁচটা স্কুলের থেকে আলাদা করেছিলেন রিপনবাবু। তাই হয়তো সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে ঋত্বিকা বলছে, ‘আপনার মতো কেউ আর গল্প শোনাবে না। মোটর সাইকেলে নিয়ে ঘুরবে না। আপনি অঙ্ক করাইতেন, কত মজা হতো। তাই চাইছি আপনি এখানে এসে মরবা।’ রিপনবাবুর চলে যাওয়ায় মন খারাপ ‘বোকা হতে চাওয়া’ ঋকেরও। এই সেই ঋক, যে বলে ছিল, ‘আমি বোকা হতে চাই।’ ঋকও রিপনবাবুর একজন প্রিয় ছাত্র। প্রিয় স্যার চলে যাওয়ায় মন খারাপ তারও। মুষড়ে পড়েছে অর্চিস্মান, অরিন্দম আলোক মালরাও। মন খারাপ গোটা শীতলগ্রামের। 

    রিপনবাবু যখন স্কুলে যোগ দেন, তখন পড়ুয়ার সংখ্যা ছিল ৪০ জন। স্কুলে নিয়মিত আসত না কেউ। তবে বর্তমানে পড়ুয়ার সংখ্যা ৮৯’র কাছাকাছি। স্কুলছুট নেই। বরং রবিবার কেন স্কুল হয় না, সেই প্রশ্ন তোলে পড়ুয়ারা। স্কুলের প্রধান শিক্ষক শান্তনু ঘোষ বলেন, ‘উনি যেহেতু স্কুলের পরেও পড়ুয়াদের সময় দিতেন। তাই কম সময়েই পড়ুয়াদের কাছে আপন হয়ে উঠেছিলেন। সেই কারণেই পড়ুয়াদের এত মন খারাপ।’ বর্তমান সময়ে প্রায় তলানিতে ঠেকে যাওয়া শিক্ষক-পড়ুয়ার সম্পর্কের মধ্যে ঋত্বিকাদের মন খারাপও আনন্দ দেয়!  ঋত্বিকা দাস।
  • Link to this news (বর্তমান)