• বন্দে মাতরম্‌ কেন মাপকাঠি দেশপ্রেমের, প্রশ্ন মুসলিম সাংসদদের
    আনন্দবাজার | ১১ ডিসেম্বর ২০২৫
  • ‘বন্দে মাতরম্’ গাওয়াকে কেন দেশপ্রেমের মাপকাঠি করে তোলা হচ্ছে? লোকসভা ও রাজ্যসভায় বন্দে মাতরম্-এর সার্ধশতবর্ষ নিয়ে আলোচনায় মুসলিম সাংসদরা নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহকে এই প্রশ্ন ছুড়লেন।

    বন্দে মাতরম্-এর সার্ধশতবর্ষ পালন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী প্রথম অভিযোগ তুলেছিলেন, মুসলিমরা ধর্মীয় কারণে বন্দে মাতরম্ গাওয়া নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন বলেই জওহরলাল নেহরু ‘সংখ্যালঘু তোষণ’-এর জন্য বন্দে মাতরম্-এর শুধু দু’টি স্তবককে জাতীয় গান হিসেবে গ্রহণ করে বাকিটা বাদ দিয়েছিলেন। মোদীর অভিযোগ, তাতেই দেশভাগের বীজ বপন হয়েছিল। পরে লোকসভায় এ নিয়ে আলোচনার গোড়ায় মোদী একই অভিযোগ তুলেছেন। রাজ্যসভায় একই সুর অমিত শাহের মুখে।

    লোকসভা ও রাজ্যসভায় মুসলিম সাংসদরা দলমত নির্বিশেষে পাল্টা অভিযোগ তুলেছেন, বন্দে মাতরম্-কে উগ্র জাতীয়তাবাদের অস্ত্র করে তুলছে শাসক বিজেপি। বন্দে মাতরম্ গাওয়াকে দেশপ্রেমের মাপকাঠি হিসেবে তুলে ধরে মুসলিমদের পরীক্ষায় বসতে বলা হচ্ছে। জোর করে বন্দে মাতরম্ গাইতে হবে বলে ধর্মীয় আচরণের মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা হচ্ছে।

    বন্দে মাতরম্-এর সার্ধশতবর্ষ নিয়ে আলোচনার শুরুতে অনেক নেতাদের কৌতূহল ছিল, মুসলিম সাংসদরা এ নিয়ে কী বলেন? বিজেপি কোনও মুসলিমকে প্রার্থী করেনি বলে লোকসভায় বিজেপির কোনও মুসলিম সাংসদ নেই। বাকি দলের সাংসদেরা আদৌ আলোচনায় অংশ নেন কি না, তা নিয়েও কৌতূহল ছিল। দেখা গিয়েছে, মুসলিম সাংসদেরা স্পষ্ট বলেছেন, এ দেশের মুসলিমরা ‘বাই চান্স’ ভারতীয় মুসলিম নন। তাঁরা ‘বাই চয়েস’ ভারতীয় মুসলিম। দেশভাগের পরেও তাঁরা ভারতকে বেছে নিয়েছেন।

    শ্রীনগরের ন্যাশনাল কনফারেন্সের সাংসদ সৈয়দ রুহউল্লাহ মেহদি অভিযোগ তুলেছেন, সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় প্রথা দিয়ে দেশপ্রেম যাচাই করা উচিত নয়। কেউ দেশপ্রেমের নামে পুজো দাবি করতে পারে না। মেহদি বলেন, “আমরাও ভারতের স্বাধীনতার জন্য বহিরাগতদের বিরুদ্ধে লড়েছি। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার বারবার মুসলিমদের বহিরাগত হিসেবে তুলে ধরে। আসলে সরকার যখন চাকরি, মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না, তখন একটা গান আনুগত্যের পরীক্ষা হয়ে ওঠে। বুলডোজ়ার দিয়ে ভাঙচুরটাই ন্যায় হয়ে ওঠে। মুসলিমরা স্থায়ী ভাবে সন্দেহভাজন হয়ে যায়।”

    ন্যাশনাল কনফারেন্সের চৌধরি মহম্মদ রমজ়ান যুক্তি দিয়েছেন, বন্দে মাতরম্ জাতীয় গান। সেই গানের সময় মুসলিমরাও উঠে দাঁড়ান। কিন্তু সেখানে ভারতমাতাকে দেবী হিসেবে পুজোর কথা বলা হয়েছে। মুসলিমরা আল্লা ছাড়া আর কারও আরাধনা করতে পারেন না। তাই মুসলিমরা বন্দে মাতরম্ গাইতে পারেন না। এর সঙ্গে দেশপ্রেমের সম্পর্ক নেই।

    আইইউএমএল (ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন অব মুসলিম লিগ)-এর সাংসদ হারিস বিরানের অভিযোগ, এই সব বিবাদ বহু বছর আগে মিটে গিয়েছে। মোদী সরকার আসলে বন্দে মাতরম্-এর নামে নিজের ব্যর্থতা থেকে নজর সরাতে চাইছে। রাজ্যসভায় কংগ্রেসের সাংসদ সৈয়দ নাসির হুসেন বুধবার বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সুভাষচন্দ্র বসুর পরামর্শেই বন্দে মাতরম-এর প্রথম দু’টি স্তবক জাতীয় গান হিসেবে গৃহীত হয়েছিল। যাতে দেশের সমস্ত সম্প্রদায় বন্দে মাতরম্-এর ভাবনার সঙ্গে একাত্ম হতে পারে। যারা স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নেয়নি, তারা স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তরাধিকার নিয়ে বিচার করতে বসেছে।

    উত্তরপ্রদেশের কৈরানার সমাজবাদী পার্টির সাংসদ ইকরা হাসান প্রশ্ন তোলেন, নরেন্দ্র মোদী কি অটলবিহারী বাজপেয়ীর বিরুদ্ধেও সংখ্যালঘু তোষণের অভিযোগ তুলতে চান? কারণ, ১৯৯৮-এ উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকার বন্দে মাতরম্ গাওয়া বাধ্যতামূলক করায় বাজপেয়ী অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে সরতে হয়েছিল। তাঁর ব্যাখ্যা, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা সেই সব স্তবককে রাষ্ট্রনেতারা বেছে নিয়েছিলেন, যেখানে দেশের জল, অরণ্য, মাটি, পরিবেশের বন্দনা রয়েছে। দেশের মানুষের মঙ্গল কামনা রয়েছে। এমআইএম প্রধান, লোকসভার সাংসদ আসাদুদ্দিন ওয়েইসি বলেছেন, মুসলিমদের ধর্ম ভারতের প্রতি মহব্বতের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। মুসলিমরা শুধু এটুকুই আশা করেন, তাঁদের উপরে জোর করে কিছু চাপিয়ে দেওয়া হবে না।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)