অর্ঘ্য বিশ্বাস, গোরুমারা
তাঁর দিন কাটত জঙ্গলে শুকনো জ্বালানি কুড়িয়ে। বনবস্তির অন্য মহিলাদের মতো এটিই ছিল জীবিকা। নাচ-গানের মাধ্যমে এই জীবন বদলে ফেলেছেন সুশীলা পাইক। বদলেছেন অন্য মহিলাদের জীবনও। সেটা দু'দশক আগের কথা। বন দপ্তরের উদ্যোগে বনবস্তিবাসীদের স্বনির্ভর করে তোলার বিশেষ প্রকল্প শুরু হয়। এই প্রকল্পের সৌজন্যে সুশীলা জ্বালানি কুড়োনোর কাজ ছেড়ে মন দেন নাচ-গানে। নিজের সুর, তালের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দিয়ে বনবস্তির মেয়েদের নাচ-গানের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। আজ বছর ৫৫-র সুশীলার হাত ধরে বহু মহিলা আজ দক্ষ নৃত্যশিল্পী।
তাঁদের কোরা ও পাইক নৃত্য গোরুমারায় বেড়াতে আসা পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণ হয়ে উঠেছে। নাচ-গানের মাধ্যমে বন ও বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের বার্তাও পৌঁছে দিচ্ছেন বনবস্তির নারীরা। ২০০৯ সালে গোরুমারার তৎকালীন ডিএফও তাপস দাস এবং গোরুমারা সাউথের রেঞ্জার বিমল দেবনাথ এখানকার ছেলেমেয়েদের স্বনির্ভর করতে উদ্যোগ নেন। বিকেলের নজরমিনার ভ্রমণের পরে পর্যটকদের জন্য সান্ধ্যকালীন আদিবাসী নাচের আয়োজন করা হয়।
বনবস্তির কয়েকজন প্রবীণ শিল্পীর অংশগ্রহণে শুরু হয় এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যা ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই পথেই পাল্টে যায় সুশীলাদের জীবন। যদিও শুরুটা সহজ ছিল না। সেই সময়ে স্মার্টফোন বনবস্তিতে আসেনি। ভাড়া করা সিডি বা ক্যাসেটও বনবস্তিতে আনা ছিল ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। তাই খালি গলায় গান শেখানোর দায়িত্ব নেন সুশীলা। আদিবাসী বিয়ের গান থেকে শুরু করে বন ও বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ বিষয়ে সঙ্গীত, সবটাই তিনি শেখাতে থাকেন ছাত্রীদের। হীরামতি পাইক, রোমা কোরা, সুনীতা পাইক, ভগবতী কোরার মতো বহু মহিলা আজ সুশীলার তালিমে স্বনির্ভর হয়েছেন। তাঁদের পরিবেশিত সান্ধ্যকালীন নাচ-গান পর্যটকদের ভালোবাসা কুড়োচ্ছে।
মহিলারা প্রায় সবাই এখন নাচ-গান শিখে স্বল্প হলেও অর্থ উপার্জন করছেন। বনবস্তির প্রবীণ শিল্পী মঙ্গল কোরা বলেন, 'নাচ-গান আমাদের আদিবাসী সমাজের অন্যতম বিনোদন। প্রবীণ শিল্পীদের প্রায় কেউই আজ নেই। তাই নবীনদের উৎসাহ দিতে আমরা শুরু থেকেই চেষ্টা করেছি। সুশীলার হাত ধরেই মেয়েরা এখন পারদর্শী হয়ে উঠেছে, এটা আমাদের কাছে গর্বের।' সুশীলার স্বামী লব পাইক বন উন্নয়ন নিগমের কর্মী। শুরু থেকেই স্ত্রীর উদ্যোগের পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি। সুশীলা বলেন, 'আগে জঙ্গলে জ্বালানি সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রায়ই বন্যপ্রাণীর মুখোমুখি হতে হতো। এখন আর কেউই জঙ্গলে যায় না। দিনে সংসারের কাজ সেরে সন্ধ্যায় নাচ-গানের জন্য সময় রাখে মেয়েরা। এর বিনিময়ে সবাই কিছু না কিছু আয় করতে পারছে, এটাই সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা।' সুশীলার মেয়ে সবিতা পাইকও এখন দলের অন্যতম নৃত্যশিল্পী। তাঁর কথায়, 'মায়ের পথ অনুসরণ করেই নাচ-গান শিখেছি। ভবিষ্যতে নতুন শিল্পী তৈরি করার চেষ্টা চালিয়ে যাব।'