১৮ মিনিটেই যবনিকা পতন! কলকাতায় মেসির সফরে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা
বর্তমান | ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫
সৌগত গঙ্গোপাধ্যায়, কলকাতা: ডিসেম্বরের শীতে মেসি উত্তাপে গা সেঁকতে তৈরি ছিল কল্লোলিনী তিলোত্তমা। বাঁ-পায়ের জাদুকরকে একবার চাক্ষুস করতে সে কী উন্মাদনা! শহরবাসী থুড়ি, নেপাল, অসম, ভাইজাগ—দূরদূরান্ত থেকে বহু অনুরাগী হাজির যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিপুল সেই ভালোবাসা-আকাঙ্ক্ষার পরিণতি ঘটল চরম বিশৃঙ্খলা ও হতাশায়। মাত্র ১৮ মিনিটেই যবনিকা পতন! মাঠে আয়োজকদের ঘনিষ্ঠ, ভিআইপি, নেতা-মন্ত্রীদের ভিড়ে মেসিকে সেভাবে দেখতেই পেলেন না দর্শকরা। অব্যবস্থার জেরে ১৮ মিনিটেই মাঠ ছাড়লেন মহাতারকা। ব্যস, ভাঙল ধৈর্যের বাঁধ। আকাশছোঁয়া দরে টিকিট কেটেও প্রিয় নায়ককে দেখতে না পাওয়ার যন্ত্রণা রূপ নিল ভয়ঙ্কর বিদ্রোহের। গ্যালারিতে ছিঁড়ে ফেলা হল মেসির ব্যানার। মাঠে উড়ে এল বোতল, ভাঙা চেয়ার!সেই শুরু। তারপর যা ঘটল তা বেনজির। ফেন্সিংয়ের গেট ভেঙে হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ যুবভারতীর মাঠে ঢুকে অবলীলায় চালালেন তাণ্ডব। আয়োজকদের ব্যর্থতায় ক্রমাগত স্লোগান দিতে দিতে স্টেডিয়ামের সম্পত্তি তছনছ করলেন তাঁরা। কেউ সবুজ গালিচায় চেয়ার দিয়ে আঘাত করলেন, কেউ আবার গোলপোস্টের জাল ছিড়তে উদ্যত। একজন তো যুবভারতীর কার্পেট মাথায় তুলে দৌড় মারলেন। বেরনোর সময় তাঁর মন্তব্য, ‘১০ হাজার টাকা দিয়ে টিকিট কেটেও মেসিকে দেখতে পাইনি। পয়সা উশুল করতে তাই এটা নিয়ে যাচ্ছি।’ স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, এই ব্যর্থতার দায় কার? কোটি কোটি টাকা খরচ করার পরও কেন স্টেডিয়ামে ন্যূনতম নিরাপত্তা নেই? কেনই বা মাঠের মধ্যে ভিআইপি-মন্ত্রীদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হল না? এর দায় কোনওভাবেই এড়াতে পারবেন না আয়োজকরা। আসলে মেসি ‘গোট ইন্ডিয়া ট্যুর’তাঁদের কাছে কেবলই ছিল টাকা ছাপার মেশিন। ১০ লক্ষ টাকার বিনিময়ে হোটেলে তাঁরা মেসির সঙ্গে ছবি তুলে দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক মানের এই ক্রীড়া ইভেন্টকে আয়োজক ও ভিআইপি-রা নিজেদের ব্যক্তিগত প্রচার ও স্বার্থসিদ্ধির মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করতে দু’বার ভাবেননি। কিন্তু গাঁটের কড়ি খরচ করে দূরদূরান্ত থেকে আসা অনুরাগীদের কাছে এই অভিজ্ঞতা নিষ্ঠুর পরিহাস ছাড়া কিছুই নয়। স্টেডিয়াম থেকে বেরনোর সময় গলা ফাটিয়ে তাঁরা একটাই প্রশ্ন করছেন, ‘এত টাকা খরচ করেও কেন খালি চোখে মেসিকে ভালোভাবে দেখতে পেলাম না? আয়োজকরা তার জবাব দিক। আমাদের আবেগ কি এতটাই ঠুনকো?’ সত্যিই কলকাতায় মেসির আগমন শহরবাসীর হৃদয়ে এক গভীর ক্ষত রেখে গেল। এটা কেবল ফুটবলপ্রেমীদের হতাশা নয়, রাজ্যের প্রশাসনিক ও ক্রীড়া সাংগঠনিক দক্ষতার ওপর এক গভীর প্রশ্নচিহ্ন। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তারকা শাহরুখ খান ও সৌরভ গাঙ্গুলিরও যুবভারতীতে মেসির সঙ্গে মঞ্চ ভাগ করে নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাঠে ঢোকার আগেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্ষমা চেয়ে মুখ্যমন্ত্রী লিখেছেন, ‘সল্ট লেক স্টেডিয়ামে এমন অব্যবস্থাপনায় আমি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন ও মর্মাহত। হাজার হাজার ক্রীড়াপ্রেমী ও ভক্তদের সঙ্গে মেসির অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আমিও স্টেডিয়ামে যাচ্ছিলাম। দুভার্গ্যজনক ঘটনার জন্য আমি লায়োনেল মেসি ও ক্রীড়াপ্রেমীদের কাছে ক্ষমা চাইছি। বিচারপতি (অবসরপ্রাপ্ত) অসীম কুমার রায়ের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করছি। যার সদস্য হিসেবে থাকবেন মুখ্য সচিব এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অতিরিক্ত মুখ্য সচিব। কমিটি ঘটনার বিস্তারিত তদন্ত করবে। আবারও আমি মেসি ও সকল ক্রীড়াপ্রেমীদের কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাইছি।’ মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পরই তড়িঘড়ি আয়োজক প্রধান শতদ্রু দত্তকে বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিস। সাংবাদিক সম্মেলন করে সেই খবর জানান রাজ্য পুলিসের ডিজি রাজীব কুমার। এছাড়া দর্শকদের টাকা ফেরত দেওয়ার কথাও বলেছেন তিনি।সত্যিই তো, মেসির ইভেন্ট ঘিরে এই ঘোরতর বিশৃঙ্খলায় মুখ পুড়ল বাংলার। অথচ, সুষ্ঠভাবে আয়োজন করলে ‘সিটি অব জয়’-এর আসল রূপ দেখতে পেতেন মেসি। যেমনটা শুক্রবার বিমানবন্দরে দেখেছিলেন। মহাতারকাকে স্বাগত জানাতে ভোররাত পর্যন্ত এয়ারপোর্টে গলা ফাটিয়েছিলেন অনুরাগীরা। মেসির প্রাইভেট জেট অবতরণ করতেই উত্সব শুরু। সাদা গাড়ির জানালা দিয়ে মেসিকে এক ঝলক দেখেই আনন্দে পাগলপারা হয়েছিলেন অনুরাগীরা। সেই দৃশ্য দেখে মেসির মুখেও হাজার ওয়াটের হাসি খেলে গিয়েছিল। গাড়ি থেকেই হাত নাড়িয়ে অনুরাগীদের অভিবাদন জানান তিনি। কিন্তু আয়োজকদের ব্যর্থতায় শনিবার সেই হাসিটাই উধাও থাকল!