• কংক্রিটের বাড়ির তুলনায় ঐতিহ্যবাহী মাটির ঘরে কার্বন নিঃসরণ কম, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় তথ্য
    বর্তমান | ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫
  • সৌম্যজিৎ সাহা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা: চিরাচরিত বা ঐতিহ্যবাহী (ভার্নাকুলার) মাটির ঘর নাকি কংক্রিটের আধুনিক বাড়ি—এমন প্রশ্ন করলে সিংহভাগ মানুষ চোখ বন্ধ করে দ্বিতীয়টি বেছে নেবে। কিন্তু পরিবেশের উপর কোনটির নেতিবাচক প্রভাব তুলনামূলক কম, তা বিচার করতে গেলে মাটির বাড়িকেই এগিয়ে রাখতে হবে। সম্প্রতি এনিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সিনিয়র গবেষক অরিত্র মজুমদার গবেষণা করেছেন। তাঁর সঙ্গে এই কাজে যুক্ত ছিলেন বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক অনুপম দেব সরকার ও কেএমডিএর প্রাক্তন মুখ্য ইঞ্জিনিয়ার কৌশিক দত্ত রায়। গবেষণার নির্যাস, পাকা বাড়ির তুলনায় মাটির বাড়ির তৈরির সময় থেকে সম্পূর্ণ ব্যবহারকাল পর্যন্ত কার্বন নিঃসরণ অনেক কম। এছাড়া, মাটির বাড়ি তৈরির সময় জল কম লাগে, যা এই জলবায়ু পরিবর্তনের সময়ে দাঁড়িয়ে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণাপত্রটি দিন কয়েক আগে ‘স্প্রিঞ্জার নেচার’-এর আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ‘জার্নাল অব হাউসিং অ্যান্ড দ্য বিল্ট এনভায়রনমেন্ট’-এ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও অরিত্রবাবু সদ্য দক্ষিণ আফ্রিকায় ইউনিভার্সিটি অব কেপটাউনে এই গবেষণাপত্র উপস্থাপন করে এসেছেন ‘নেট জিরো ফিউচার ২০২৫’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে। পশ্চিমবঙ্গের সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল ও গাঙ্গেয় উপত্যকা অঞ্চলে সমীক্ষাটি করা হয়েছে।

    গবেষণায় জানা গিয়েছে, একটি কংক্রিটের বাড়ি থেকে ৬৪ হাজার ৮৭৭ কেজি কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে। এটি তৈরি করতে যেসব প্রাকৃতিক সম্পদ লেগেছে, তার পরিমাণ ৬,৩২,৭৩৯ মেগা জুল। আর ৪৮,৫৫৩ এম কিউব জল ব্যবহার হয়। সেই তুলনায় মাটির বাড়ির ক্ষেত্রে কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে ৩০,৯৪৫ কেজি। অন্যান্য উপাদান লেগেছে ৩,১৪,৭৪৯ মেগা জুল এবং ১০,৬৮৪ এম কিউব জল ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ ঐতিহ্যবাহী মাটির বাড়ি থেকে কংক্রিটের বাড়ির তুলনায় ৫২.৩ শতাংশ কম কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে। ৫০.২৬ শতাংশ কম প্রাকৃতিক উপাদান খরচ হচ্ছে এবং ৭৭.৯৯ শতাংশ কম জল লাগছে। 

    অরিত্রবাবুর কথায়, ‘এই গবেষণায় লাইফ সাইকেল অ্যাসেসমেন্ট পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। একটি বাড়ি তৈরি থেকে শুরু করে তার ব্যবহারকাল, এমনকি ভেঙে ফেলার সময় তার সমস্ত উপকরণ, শক্তি ও জলের ব্যবহার হিসেব করা হয়েছে। নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এসেছে এই ফলাফল। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল লৌকিক স্থাপত্য তথা ঐতিহ্যবাহী মাটির বাড়ি এবং কম খরচের কংক্রিটের বাড়ির তুলনা করে দেখা, কোনটি পরিবেশের জন্য ভালো এবং দীর্ঘমেয়াদি। তাতে দেখা গেল, ঐতিহ্যবাহী মাটির বাড়ি আজও কতটা প্রাসঙ্গিক। এখনও গ্রামে কাদামাটি, খড়, বাঁশ, কাঠ ব্যবহার করে বাড়ি তৈরি হয়। এসব ঘর শুধু আরামদায়কই নয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় তুলনামূলক নিরাপদ। এখন আধুনিক উপকরণ যেমন সিমেন্ট, রড, বালি ইত্যাদি ব্যবহারে খরচ যেমন বেড়েছে, তেমনই পরিবেশের ক্ষতিও হচ্ছে বেশি।’ গবেষকদের বক্তব্য, যদি ঐতিহ্যবাহী নির্মাণের এই জ্ঞানকে আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে মিলিয়ে ব্যবহার করা যায়, তাহলে আরও টেকসই ও পরিবেশবান্ধব ঘরবাড়ি তৈরি করা সম্ভব। সরকার এই পথ অনুসরণ করলে আগামী দিনে আবাসন নীতিতে নয়া দিগন্ত খুলে যেতে পারে। উপকূলীয় অঞ্চল ও গাঙ্গেয় উপত্যকা অঞ্চলের মতো জলবায়ু পরিবর্তনের নিরিখে ‘সংবেদনশীল’ এলাকার জন্য এই গবেষণা ভবিষ্যতের দিশা দেখাতে পারে।  চলছে গবেষণার কাজ।-নিজস্ব চিত্র
  • Link to this news (বর্তমান)