• মেসির সফরে রণক্ষেত্র যুবভারতী, হতাশার বিস্ফোরণ, গ্রেফতার উদ্যোক্তা, তদন্ত কমিটি
    বর্তমান | ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫
  • শিবাজী চক্রবর্তী ও স্বার্ণিক দাস, কলকাতা: গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে লায়োনেল মেসিকে দেখতে শনিবার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে উপচে পড়েছিলেন অনুরাগীরা। নীল-সাদা জার্সির উপর জ্বলজ্বল করছিল মহাতারকার ছবি। প্রবল উৎসাহ এবং আবেগে ভর করেই সাতসকালেই তিলোত্তমা ‘মেসিময়’। কিন্তু তার রেশ দীর্ঘস্থায়ী হল না। বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ হোটেল থেকে বিলাসবহুল গাড়িতে চড়ে মেসি হাজির হন মাঠে। সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে ঘিরে ফেলেন মূল উদ্যোক্তা শতদ্রু দত্ত থেকে মন্ত্রী-সান্ত্রী, আমলা, টলিউডের একাধিক নায়িকা, আয়োজকদের পেটোয়া কলমচি, কতিপয় ফুটবল কর্তা এবং তথাকথিত প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। শুরু হয়ে যায় চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা। বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলারকে ঘিরে ধরে সপরিবারে প্রভাবশালীদের হ্যাংলামো ছিল সত্যিই দৃষ্টিকটু। এই বিড়ম্বনায় ক্ষুব্ধ হন মেসি। তাঁর মতো ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইড সেলিব্রিটি’র জন্য যে পরিকল্পনা ও তার প্রয়োগক্ষমতা প্রয়োজন, তার বিন্দুমাত্রও এদিন সেখানে ছিল না। 

    বৈধ টিকিট স্ক্যান না হওয়া, হাজার হাজার টাকা খরচ করেও গ্যালারি থেকে মেসিকে দেখতে না পেয়ে স্বাভাবিকভাবে গর্জে ওঠেন ক্রীড়াপ্রেমীরা। কিন্তু সেই চিৎকারে কর্ণপাত করেননি কেউই। শুধু সেলফি তোলার হিড়িকই নয়, এলএমটেনের অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য আদিখ্যেতার বহরের সাক্ষীও ছিল গ্যালারি। মাত্র ১৮ মিনিট মাঠে ছিলেন স্বপ্নের নায়ক। তার মধ্যেই তিনি বুঝে যান, হাওয়া খারাপ! তাই নিরাপত্তারক্ষীদের ঘেরাটোপে মাঠ থেকে সোজা বিমানবন্দরের দিকে রওনা দেন। সঙ্গে ছিলেন লুইস সুয়ারেজ ও রডরিগো ডে পল। আর এরপরেই সমর্থকদের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে। গ্যালারিতে থাকা প্রত্যেকে বুঝে যান, কড়ি ফেললেও তেল মাখা আর সম্ভব নয়। হতাশার বিস্ফোরণে শুরু হয় বোতলবৃষ্টি। গ্যালারি থেকে তা উড়ে আসে মাঠে। এই সময়েই হোটেল থেকে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে আসেন শাহরুখ খান। যদিও মাঠে ঢোকেননি। নিজের গাড়িতে বসেছিলেন। অবস্থা বেগতিক দেখে দ্রুত মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে যান সৌরভ গাঙ্গুলিও। এরপর দর্শকদের রোষ আরও বাড়ে। প্ল্যাকার্ড, ব্যানার, হোর্ডিং, ক্যানোপি, এমনকি গ্যালারির বাকেট চেয়ারও তাঁরা ভাঙতে থাকেন। শুধু তাই নয়, ভাঙা চেয়ার উড়ে আসে মাঠে। আহত হন একাধিক পুলিশ কর্মী। আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় ভিআইপিদের বসার জন্য রাখা সোফায়। এই পর্বে পুলিশ অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের ভূমিকায় ছিল। তাই ফেন্সিং-ব্যারিকেড ভেঙে মাঠের দখল নেন ক্ষুব্ধ ক্রীড়াপ্রেমীরা। পিলপিল করে মানুষ যুবভারতীর সবুজ ঘাসে রীতিমতো তাণ্ডব চালায়। ছিঁড়ে ফেলে গোলপোস্টের জাল। প্রবল আগ্রহে অনেকে বাড়ি নিয়ে যান কার্পেট, ফুলের টব ও ভাঙা চেয়ার। 

    এরইমধ্যে গোটা ঘটনা জানতে পেরে মাঝপথ থেকেই ফিরে যান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শাহরুখও ততক্ষণে বিমানবন্দরের পথে। ঠিক এই সময় গেরুয়া পতাকা নিয়ে জনৈক দর্শক মাঠে ঢুকে পড়েন। ওঠে জয় শ্রীরাম স্লোগানও। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে মৃদু লাঠিচার্জ করে পুলিশ। ক্ষুব্ধ সমর্থকদের তাড়া করে গ্যালারিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তবে পরিস্থিতি তখনও পুরোপুরি শান্ত হয়নি। পুলিশের সঙ্গে কয়েক দফা লুকোচুরি খেলার পর ক্রমশ মাঠ ছাড়তে থাকেন মেসি-ভক্তরা। এই পর্বে গোলমাল ছড়িয়ে পড়ে মাঠের বাইরেও। গোটা ঘটনার জন্য এক্স হ্যান্ডলের মাধ্যমে মেসির কাছে দুঃখপ্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী। পাশাপাশি যুবভারতী কাণ্ডের তদন্তে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠনের ঘোষণাও। ২ সপ্তাহে তারা রিপোর্ট জমা দেবে।

    পরিস্থিতি শান্ত করতে দুপুর দেড়টা নাগাদ বাড়তি ফোর্স আসে যুবভারতীতে। সংগঠক ও মন্ত্রী-সান্ত্রীদের তীব্র ধিক্কার জানাতে জানাতে মেসিপ্রেমীরা মাঠ ছাড়েন। এই সময়েই সাংবাদিক সম্মেলনে রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমার বলেন, ‘এই অব্যবস্থা কেন হল, কোথায় খামতি ছিল তা উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি খতিয়ে দেখছে। ক্রীড়াপ্রেমীরা মেসিকে কার্যত দেখতে পাননি। অনেকেরই মনে হয়েছে, তাঁরা প্রতারিত। তাঁদের টিকিটের টাকা ফিরিয়ে দেওয়া উচিত উদ্যোক্তাদের।’ 

    এরপরেই এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) জাভেদ শামিমের মন্তব্য, ‘হায়দরাবাদ যাওয়ার পথে কলকাতা বিমানবন্দর থেকে উদ্যোক্তা শতদ্রু দত্তকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’ বিধাননগর কমিশনারেট জানিয়েছে, এই ঘটনায় বিধাননগর দক্ষিণ থানায় বিশৃঙ্খলার অভিযোগে প্ররোচনা, উসকানি সহ একাধিক ধারায় স্বতঃপ্রণোদিত মামলা রুজু হয়েছে।
  • Link to this news (বর্তমান)