গ্যালারি থেকে মেসিকে দেখতে না পেয়ে যুবভারতীতে বিশৃঙ্খলা ও ভাঙচুর
দৈনিক স্টেটসম্যান | ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫
এই ঘটনার পর ব্যথিত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সমাজমাধ্যমে ঘটনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তিনি মেসি ও সকল ক্রীড়াপ্রেমীদের কাছে ক্ষমা চান এবং অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অসীমকুমার রায়ের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণা করেন। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। ভবিষ্যতে এমন ঘটনা রুখতে তদন্ত কমিটি প্রয়োজনীয় সুপারিশ করবে।
নিজের এক্স অ্যাকাউন্টে মুখ্যমন্ত্রী লেখেন, ‘সল্টলেক স্টেডিয়ামে আজ যে অব্যবস্থা দেখা গেল, তাতে আমি বিচলিত এবং স্তম্ভিত।’ তিনি জানান, মেসিকে এক ঝলক দেখার জন্য যখন হাজার হাজার দর্শক যুবভারতীতে জমায়েত হয়েছিলেন, তখন তিনিও ওই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু বিশৃঙ্খলার খবর পেয়ে মাঝপথ থেকেই তাঁকে ফিরে আসতে হয় বলে প্রশাসনিক সূত্রে জানা গিয়েছে। এর পরেই মুখ্যমন্ত্রী লেখেন, ‘এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার জন্য আমি লিয়োনেল মেসি, সকল ক্রীড়াপ্রেমী এবং তাঁর ভক্তদের কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থী।’
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, বিশৃঙ্খলার তদন্তে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অসীমকুমার রায়ের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটিতে সদস্য হিসেবে থাকবেন মুখ্যসচিব, অতিরিক্ত মুখ্যসচিব এবং স্বরাষ্ট্র ও পার্বত্য বিষয়ক দপ্তরের প্রতিনিধিরা। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ‘কমিটি এই ঘটনার বিশদ তদন্ত করবে, দায়ীদের চিহ্নিত করবে এবং ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের সুপারিশ করবে।’ পোস্টের শেষে তিনি আরও একবার সকল ক্রীড়াপ্রেমীর কাছে ক্ষমা চান।
প্রশাসনিক প্রতিনিধি ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গিয়েছে, শনিবার সকাল প্রায় এগারোটা ত্রিশ মিনিট নাগাদ যুবভারতীতে প্রবেশ করে মেসির গাড়ি। তাঁর সঙ্গে ছিলেন লুইস সুয়ারেজ এবং রডরিগো ডি’পল। ফুটবলপ্রেমীদের উন্মাদনা দেখে মেসিকে উচ্ছ্বসিত মনে হলেও গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে ঘিরে ধরেন বহু মানুষ। এর ফলে গ্যালারি থেকে মেসি, সুয়ারেজ এবং রডরিগোকে ঠিকভাবে দেখা যায়নি।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, আয়োজকদের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ভুলে মাঠের মাঝখানে ভিড় এতটাই ঘন হয়ে যায় যে, মেসির হাঁটার জায়গাটুকুও থাকেনি। ওই অবস্থায় ক্যামেরা ও মোবাইল দিয়ে ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন অনেকে। নিরাপত্তারক্ষীরা ভিড় সরানোর চেষ্টা করলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। গ্যালারি থেকে মেসিকে দেখার একমাত্র ভরসা ছিল স্টেডিয়ামের জায়ান্ট পর্দা। কিন্তু সেখানেও স্পষ্ট ছবি মেলেনি বলে অভিযোগ। এক পর্যায়ে ক্ষুব্ধ দর্শকদের একাংশ ‘উই ওয়ান্ট মেসি’ ধ্বনি দিতে শুরু করেন। ক্রমে উত্তেজনা বাড়তে থাকে এবং মাঠের ভিতরের পরিস্থিতি ক্রমশ বিশৃঙ্খলার রূপ নেয়। মেসিকে নিরাপত্তার কারণে মাঠ থেকে বের করে নিয়ে যাওয়ার পর পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। অভিযোগ, প্রায় দু’ থেকে আড়াই হাজার মানুষ ফেন্সিং ভেঙে মাঠে ঢুকে পড়েন। ভাঙচুর করা হয় গোলপোস্টের জাল, ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাজঘরে যাওয়ার টানেলের ছাউনি। উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে স্টেডিয়ামের বাইরেও। পরিস্থিতি সামাল দিতে বিশেষ পুলিশ বাহিনীকে মাঠে নামাতে হয়।
এই পরিস্থিতিতে মাত্র ষোলো–সতেরো মিনিট মাঠে থাকার পর নিরাপত্তার কারণে মেসিকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়। তখনও মাঠে পৌঁছননি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, শাহরুখ খান বা সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। মেসি বেরিয়ে যেতেই পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। চড়া দামে টিকিট কেটেও প্রিয় তারকাকে দেখতে না পাওয়ায় গ্যালারিতে রীতিমতো ভাঙচুর শুরু হয়ে যায়। চেয়ার ভেঙে ছোঁড়া হয় মাঠে, উড়তে থাকে ঝাঁকে ঝাঁকে জলের বোতল। ফেন্সিংয়ের গেট ভেঙে শয়ে শয়ে মানুষ মাঠে ঢুকে পড়েন। প্রথমে পুলিশ দিশাহারা হয়ে পড়লেও পরে লাঠি উঁচিয়ে জনতাকে সরানোর চেষ্টা করা হয়। তাতেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। শেষ পর্যন্ত বিশেষ বাহিনী নামাতে হয় এবং কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করা হয়।
এদিকে স্টেডিয়ামের বাইরেও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বাইপাস এলাকায় পুলিশের সঙ্গে জনতার ধস্তাধস্তি শুরু হয়। অভিযোগ ওঠে, কিছু দর্শক ঘাস, চেয়ার এমনকি ফুলের টব নিয়ে বেরিয়ে যান। ফলে নিরাপত্তা ও ভিড় নিয়ন্ত্রণে বড়সড় গাফিলতির অভিযোগ উঠেছে আয়োজকদের বিরুদ্ধে।
ঘটনার পর রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমার জানান, দর্শকদের একাংশের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। কারণ অনেকেই ভেবেছিলেন মেসি খেলবেন বা দীর্ঘ সময় মাঠে থাকবেন। আয়োজকদের পরিকল্পনা ছিল, তিনি কিছুক্ষণের জন্য মাঠে এসে দর্শকদের অভিবাদন জানাবেন এবং নির্দিষ্ট কয়েকজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে চলে যাবেন। কিন্তু এই বার্তা স্পষ্টভাবে দর্শকদের কাছে পৌঁছয়নি বলেই পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যায়।
ডিজি আরও বলেন, ‘রাজ্য সরকার ইতিমধ্যেই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। আয়োজকদের তরফে কোনও গাফিলতি ছিল কি না, নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কোথাও ত্রুটি ছিল কি না, তার সব দিক খতিয়ে দেখা হবে। এই ঘটনায় ইতিমধ্যে আয়োজকদের আটক করা হয়েছে এবং আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ করা হচ্ছে।’
তিনি জানান, প্রশাসনের তরফে আয়োজকদের কাছ থেকে লিখিত আশ্বাস নেওয়া হয়েছে যে, টিকিটের টাকা দর্শকদের ফেরত দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে প্রধান আয়োজক শতদ্রু দত্তকে কলকাতা বিমানবন্দর থেকে আটক করা হয়েছে এবং ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হবে বলে জানা গিয়েছে। প্রসঙ্গত, ডিজি রাজীব কুমার আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘দর্শকদের টাকা না ফেরালে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
অন্যদিকে, পুলিশের আইনশৃঙ্খলা বিভাগের অতিরিক্ত ডিরেক্টর জেনারেল জাভেদ শামিম বলেন, ‘শান্তি ফিরিয়ে আনা ছিল আমাদের প্রথম কাজ। পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে। দর্শকরা সবাই বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। ঘটনা যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনেই সীমাবদ্ধ ছিল। এখন যান চলাচল স্বাভাবিক।’ তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন, ঘটনাটি গুরুতর এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উল্লেখ্য, ফুটবলপ্রেমী শহরে যে অনুষ্ঠান ঘিরে স্বপ্ন ও আবেগ জমা হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত ভাঙচুর আর হতাশার বিষাদ চিত্রে ঢেকে গেল। মেসিকে ঘিরে পরিকল্পনার অভাব, ভিড় নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতা এবং আয়োজকদের গাফিলতি— সব মিলিয়ে যুবভারতীর এই দিন শহর কলকাতার ইতিহাসে এক অস্বস্তিকর স্মৃতি হয়ে থেকে গেল।