অর্কদীপ্ত মুখোপাধ্যায়: বিএলও'দের অ্যাপে খসড়া তালিকা আপলোডের কাজ বাংলায় শুরু হয়ে গেল। এসআইআর প্রক্রিয়ার প্রথম পর্ব শেষে মঙ্গলবার খসড়া তালিকা প্রকাশের দিন ধার্য করেছিল নির্বাচন কমিশন। তার ২৪ ঘণ্টা আগেই বুথওয়াড়ি বিএলও'দের আ্যাপে কাদের নাম খসড়া তালিকায় রয়েছে তা জানা যাচ্ছে। সিইও অফিস সূত্রের খবর, রাজ্যের প্রায় ৮১ হাজার বুথের বিএলও'দের অ্যাপে খসড়া তালিকা আপলোডের পাশাপাশি ছাপার অক্ষরে তালিকাও বুথে বুথে পৌঁছে যাবে। মঙ্গলবার খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশের আগেই নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যাচ্ছে, প্রায় ৫৯ লক্ষ ভোটারের নাম তালিকা থেকে বাদ পড়তে পারে। পাশাপাশি ১ কোটি ৯০ লক্ষ ভোটারের কাছে নোটিস পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে, যাঁদের তথ্য যাচাইয়ের জন্য শুনানিতে ডাকা হতে পারে।
কমিশন সূত্রে খবর
খসড়া ভোটার তালিকা বেরোনোর পরেই শুরু হচ্ছে না হিয়ারিং। সময় লাগবে কিছুদিন। যাদেরকে হিয়ারিং ডাকা হবে তাদের প্রত্যেকের বাড়িতে চিঠি পাঠাবে নির্বাচন কমিশন। বড় দিনের আগেই চিঠি পৌঁছবে প্রত্যেকের বাড়িতে যাদের হিয়ারিং এ ডাকা হবে। চলতি মাসের শেষের দিকে শুরু হবে হিয়ারিং।
এস আই আর শুরুর সময় স্বাভাবিকভাবে একটা ধারণা ছিল যে ২০০২ এর তালিকার সাথে কোন রকম ভাবে যোগসূত্র স্থাপন করা গেলে ভোটার তালিকায় নাম তুলতে অসুবিধা হবে না। অনেকেই এইভাবে ম্যাপিং করিয়েছেন এবং এই পদ্ধতিকে বলা হয় progeny ম্যাপিং। কমিশন সূত্রে খবর, এইভাবে যারা ম্যাপিং করিয়েছেন তাদের অনেককেই হিয়ারিংয়ে ডাকতে চলেছে নির্বাচন কমিশনে। এই সংখ্যাটা কোটি ছাড়িয়ে যেতে পারে। এই কারণেই প্রত্যেক ইআরো এবং প্রত্যেক এইআরো কে দিনে পঞ্চাশ এর জায়গায় ১০০ টা করে হিয়ারিং করার নির্দেশ দিয়েছে কমিশন।
রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের ব্রিফিং
১. দুপুরের মধ্যে খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশের কথা ভাবা হচ্ছে। BLO-BLA 2 দের MINUTES আপলোড হয়ে গিয়েছে সব।
২. রাজ্যের প্রত্যেক BLO ও BLA-2 দের কাছে মৃত, ভুয়ো, স্থানান্তরিত ও অনুপস্থিত ভোটারদের তালিকা রয়েছে। ৬০০ বুথ বাদে রাজ্যের সমস্ত বুথেই ওই তালিকা টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে।
৩. কাল-পরশু থেকে নোটিশ ইস্যু শুরু হবে। ৬-৭ দিন পর হিয়ারিং শুরু হবে। যাঁদের হিয়ারিং-এ ডাক পড়বে বাড়ি গিয়ে BLO তাঁদের নোটিশ দিয়ে আসবেন।
৫. ম্যাপিং-এ হদিশ মেলেনি প্রায় ৩০ লক্ষ ভোটারের নাম। তাঁদের হিয়ারিং-এ ডাক পড়বেই। আর এ ছাড়া, Logical Discrepancies-এর তালিকায় যে ১ কোটি ৬৭ লক্ষ ভোটারের নাম পাওয়া গিয়েছে (যেখানে প্রোজেনি ম্যাপিং-এ সমস্যা বা বাবা-ছেলের বয়সের অন্তর ১৫ বছরের নীচে বা দাদু-নাতির বয়সের অন্তর ৪০ বছরের নীচে), সেই তথ্য নিয়মিত স্ক্রিনিং করছে কমিশন। ১ কোটি ৬৭ লক্ষের তথ্য স্ক্রিনিঙয়ের পর যে সংখ্যা এসে দাঁড়াবে, সেই সংখ্যক ভোটারকেও হিয়ারিং-এর জন্য ডাকা হবে।
৪. ৫৯ লক্ষ ভোটার যাদের নাম বাদ পড়েছে, তাদের মধ্যে যদি কেউ চান, তাহলে Form 6 অ্যাপ্লাই করে ভোটার তালিকায় নাম তোলার জন্য আবেদন করতে পারবেন।
৭. এমন কোনও ঘটনা ঘটবে না যে কেউ ফর্ম ফিলআপ করেছেন, অথচ তাঁর নাম খসড়া তালিকায় বেরোবে না।
কেন যাচ্ছে এত নোটিস?
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গিয়েছে, ভোটারদের দেওয়া এনুমারেশন ফর্মে নানা অসঙ্গতি ও গরমিল ধরা পড়েছে। সেই কারণেই শুনানির জন্য নোটিস পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে—
১. ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় নাম নেই বা
২. সেই তালিকায় বাবা, মা, দাদু, দিদা বা পরিবারের কারও নাম নেই—এমন ভোটার
৩. বয়স সংক্রান্ত অসঙ্গতি
৪. বাবার নাম বা বয়স নিয়ে তথ্যের গরমিল
এই সব মিলিয়ে প্রায় ১ কোটি ৯০ লক্ষ ভোটারকে শুনানিতে ডাকা হতে পারে, যার মধ্যে প্রায় ৩০ লক্ষ ‘আনম্যাপড ভোটার’ রয়েছেন।
৪৫ বছর বয়সিদের কেন ডাকা হচ্ছে?
কমিশন সূত্রে জানানো হয়েছে, যাঁদের বয়স এখন ৪৫ বা তার বেশি, তাঁদের একটি বড় অংশকে নোটিস পাঠানো হতে পারে। কারণ—
রাজ্যে শেষ বার SIR হয়েছিল ২০০২ সালে। এখন কারও বয়স ৪৫ হলে, ২০০২ সালে তাঁর বয়স ছিল প্রায় ২২ অর্থাৎ ভোটার তালিকায় নাম থাকার কথা। কিন্তু ২০০২ সালের ভোটার তালিকা বা ২০০৬ সালের বিধানসভা ভোটের তালিকায় যাঁদের নাম পাওয়া যাচ্ছে না, তাঁদের পরিচয় ও নাগরিকত্ব নিয়ে কমিশনের সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
কোন কোন গরমিলে ডাকা হতে পারে শুনানিতে?
কমিশনের প্রাথমিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী—
২০০২ সালের তালিকায় নিজের বা পরিবারের নাম নেই: ২৪ লক্ষ ২১ হাজার ১৩৩ জন
৪৫ বছরের বেশি বয়স অথচ পুরনো তালিকায় নাম নেই: ২০ লক্ষ ৭৪ হাজার ২৫৬ জন
বাবার নাম নিয়ে অসঙ্গতি: ৮৫ লক্ষ ১ হাজার ৪৮৬ জন
বাবার বয়স নিয়ে ধন্দ: প্রায় ২০ লক্ষ ভোটার
এই ভোটারদের বড় অংশই নোটিস পেতে পারেন।
শুনানিতে কী নথি দেখাতে হবে?
খসড়া তালিকা প্রকাশের পর শুনানি পর্বে যাঁদের ডাকা হবে, তাঁদের নির্বাচন কমিশনের গাইডলাইন অনুযায়ী ১১টি নথির মধ্যে যেকোনও একটি দেখালেই চলবে। কমিশন স্পষ্ট করেছে, এই নথিগুলির যেকোনও একটি বৈধ হলেই গ্রহণযোগ্য।
নথিগুলির মধ্যে রয়েছে—
সরকারি কর্মী বা পেনশনভোগীর পরিচয়পত্র
১ জুলাই ১৯৮৭–র আগে ইস্যু করা সরকারি/ব্যাঙ্ক/LIC/PSU নথি
জন্ম শংসাপত্র
পাসপোর্ট
মাধ্যমিক বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শংসাপত্র
স্থায়ী আবাসিক (ডমিসাইল) শংসাপত্র
বনাধিকার শংসাপত্র
জাতি শংসাপত্র
NRC সংক্রান্ত নথি (যেখানে প্রযোজ্য)
পরিবার নিবন্ধন নথি
সরকারি জমি বা বাড়ি বরাদ্দের নথি
ডমিসাইল সার্টিফিকেট নিয়ে নতুন জট
এই প্রক্রিয়ায় ডমিসাইল সার্টিফিকেট ঘিরে নতুন করে কড়াকড়ির ইঙ্গিত দিয়েছে কমিশন। সূত্রের দাবি, ভিত্তিহীন বা ভুয়ো তথ্যের ভিত্তিতে ডমিসাইল সার্টিফিকেট ইস্যু হলে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। শুধু আবেদনকারী নয়, যাঁরা সেই শংসাপত্র ইস্যু করেছেন, তাঁদেরও কৈফিয়ত দিতে হতে পারে।
এই প্রসঙ্গে ভোটকর্মী ঐক্যমঞ্চের নেতা সুব্রত বাবু বলেন, 'ডমিসাইল সার্টিফিকেট সাধারণত SDO, ADM বা DM–রা সমস্ত নিয়ম মেনে তদন্ত করেই দেন। নিয়ম মেনে ইস্যু হলে সেই শংসাপত্র অবশ্যই গ্রহণযোগ্য।'
সব মিলিয়ে, মঙ্গলবার প্রকাশিত হতে চলা খসড়া ভোটার তালিকা এবং তার পরবর্তী শুনানি পর্ব পশ্চিমবঙ্গের ভোটার রাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলতে পারে বলেই মনে করছেন প্রশাসনিক মহল।