• দেশের বদনাম বলে সরব দেব, একই সুর কলকাতার বিশিষ্টদের
    এই সময় | ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫
  • এই সময়: কলকাতায় লিওনেল মেসিকে ঘিরে যে অভূতপূর্ব বিশৃঙ্খলা ও অব্যবস্থা দেখা গিয়েছিল, তার অভিঘাত এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি নাগরিক সমাজ। ঘটনার অব্যবহিত পরে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শিবিরের একাংশ প্রায় নীরব থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই নীরবতা ভাঙছে। কলকাতার বিশিষ্টজনরা, প্রথম সারির অভিনেতা-পরিচালক থেকে শুরু করে শিক্ষাবিদ ও চিকিৎসকদের মতো নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা সেই ‘মেসি–কেলেঙ্কারি’ নিয়ে নিজেদের ক্ষোভ ও আক্ষেপ এখন খোলাখুলি প্রকাশ করছেন। অভিনেতা তথা তৃণমূল সাংসদ দেবের মতো ব্যক্তিত্বও মনে করছেন, ওই ঘটনা শুধু কলকাতার নয়, সারা বিশ্বের দরবারে ভারতের সম্মানহানি করেছে।

    গত শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর সল্টলেকের যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে হওয়া ঘটনা থেকে যে নেতিবাচক বার্তা গিয়েছে, তা নিয়ে সব চেয়ে বেশি আক্ষেপ শোনা গেল অভিনেতা দেবের কথায়। সামগ্রিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে দেব বলেন, ‘পৃথিবী জুড়ে শুধু কলকাতারই নাম খারাপ হলো, এমন নয়। সারা পৃথিবীর কাছে ভারতের ব্যাপারেও খারাপ বার্তা গেল।’ তাঁর কথায় বার বারই বেরিয়ে এসেছে হারানো ইমেজের প্রসঙ্গ। দেবের বক্তব্য, ‘মেসি একজন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। তাঁর মতো তারকাকে ঘিরে যে অব্যবস্থা চোখে পড়েছে, তাতে দেশের ইমেজ নষ্ট হয়েছে। এখন সবার ভাবা উচিত, কী ভাবে সেই হারানো ইমেজ ফিরিয়ে আনা যায়।’

    তবে শুধু দেব নন, টলিউডের আরও কয়েক জন সরব হয়েছেন এ ব্যাপারে। অভিনেতা অঙ্কুশ হাজরা, টোটা রায়চৌধুরীর মতো তারকারাও নিজেদের বিরক্তি চেপে রাখেননি। টোটার কথায়, ‘আমার সব চেয়ে বেশি খারাপ লেগেছে, ওই ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলোকে কাঁদতে দেখে। ওটা খুবই হৃদয়বিদারক।’ তিনি চান, ভবিষ্যতে মেসির মতো এত বড় মাপের তারকাকে শহরে আনার আগে যেন ব্যবস্থাপনার দিকে বিশেষ ভাবে নজর দেওয়া হয়। জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত পরিচালক ও অভিনেতা কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় সরাসরি প্রশ্ন তুলেছেন আয়োজকদের এক্তিয়ার ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। তাঁর মতে, আন্তর্জাতিক মানের তারকার প্রতি সম্মান দেখানোর ক্ষেত্রে সংগঠকদের সদিচ্ছার অভাব ছিল।

    কৌশিক বলেন, ‘আমাদের বুঝতে হবে, আমাদের ক্ষমতা কতটায় যে কোনও মানুষকেই তাঁর স্পেস দেওয়া দরকার। মেসিকেও। মাঠে মেসির পাশে ভিড় না–করে যদি তাঁকে একটা হুডখোলা জিপে ঘোরালে অথবা পায়ে একটা ফুটবল দিয়ে তাঁকে মাঠটা ছেড়ে দিলে কী হতো? মেসির ভাষাতেই তাঁকে কথা বলার সুযোগ করে দিলে কী হতো? মানুষ তো মেসিকেই দেখতে এসেছিলেন।’ এই মন্তব্যে কৌশিকের সম্ভবত ইঙ্গিত, সাধারণ দর্শক ও তারকার ‘স্পেস’ নষ্ট করার যে প্রবণতা ভিআইপি–দের ভিড়ে দেখা গিয়েছিল, তা অনুচিত।

    এই ক্ষোভ কেবল বিনোদন জগতেই সীমাবদ্ধ নেই। সমাজের অন্যান্য স্তরের মানুষও এই অব্যবস্থা নিয়ে সরব। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য শান্তা দত্ত দে মনে করেন, ‘আসলে আমাদের পোড়া মুখ আরও একবার পুড়ল। মেসি এবং অন্য দুই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন খেলোয়াড়ের (রদ্রিগো দে পল এবং সুয়ারেস) সামনে বেআব্রু হয়ে গেল পশ্চিমবঙ্গের চূড়ান্ত রাজনৈতিক দৈন্য।’ শান্তার আক্ষেপ, ‘যেখানে খেলোয়াড়দের থাকার কথা, সেখানে নেতা-মন্ত্রী, তাঁদের আত্মীয়-স্বজন ও সিনেমা আর্টিস্টরা ঘিরে থাকলেন। আর তাঁদের জন্যই টিকিট কেটে আসা অগণিত ক্রীড়াপ্রেমী সাধারণ মানুষ মেসিকে দেখতে পেলেন না।’ বিশিষ্ট চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, ‘আসলে অদক্ষ আয়োজনটাই মুখ পুড়িয়েছে। প্রশাসন কেন এই অব্যবস্থার কথা আগাম জানতে পারেনি বা সঠিক ব্যবস্থা নিতে পারেনি, সেটাই স্পষ্ট হচ্ছে না।’ আয়োজক সংস্থা ও প্রশাসনের কর্তারা কী করছিলেন, সেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন সুবীর-সহ বহু নাগরিক। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বিতান ইসলামের কথাতেও সেই আফসোসই প্রতিফলিত— ‘আমি সে দিন মাঠে ছিলাম। এই ঘটনা আমাদের মাথা হেঁট করে দিয়েছে। সারা পৃথিবী আমাদের ভালোবাসার শহরটাকে এই ভাবে দেখল!’

    ওই ঘটনার জেরে পুলিশ ও প্রশাসনিক স্তরে কিছু পদক্ষেপ মঙ্গলবার করা হয়েছে। নাগরিক সমাজের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর স্পষ্ট করে দিচ্ছে, অব্যবস্থার দায় আর এড়ানো সম্ভব নয়। হারানো সম্মান ফেরাতে অবিলম্বে কঠোর পদক্ষেপ ও সুব্যবস্থার উপর জোর দেওয়ার দাবি ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠছে, প্রশাসনের তরফে এ রকম তৎপরতা আগে দেখা গেলে সারা পৃথিবীর কাছে তিলোত্তমা কলকাতার মাথা হয়তো এ ভাবে হেঁট হয়ে যেত না।

  • Link to this news (এই সময়)