• ‘আদিখ্যেতা’য় ক্ষুব্ধ অভিষেক, মুখ্যমন্ত্রীর ‘দুষ্টু-মিষ্টি ওষুধ’
    আনন্দবাজার | ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫
  • যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে লিয়োনেল মেসির সংবর্ধনা ঘিরে বিশৃঙ্খলায় ঘরে-বাইরে স্পষ্ট বার্তা দিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।

    মাঝপথে পণ্ড হয়ে যাওয়া অনুষ্ঠান, তড়িঘড়ি স্টেডিয়াম ছেড়ে মেসির প্রস্থান ও ক্ষুব্ধ দর্শকদের ভাঙচুর প্রসঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক বুধবার বলেছেন, ‘‘আয়োজকদের গাফিলতি তো ছিল, প্রশাসন-পুলিশের শিথিলতাও ছিল।’’ সেই সঙ্গেই কারও কারও ‘আদিখ্যেতা’র ফলে আন্তর্জাতিক স্তরে বাংলার মাথা হেঁট হয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। অভিষেকের কথায়, ‘‘আয়োজক, প্রশাসন এমনকি রাজ্য মন্ত্রিসভার সদস্য, যিনিই হোন না কেন, সবাইকে জবাবদিহি করতে হবে।’’ তবে এই ঘটনা নিয়ে বিরোধীরা রাজনীতি করছে বলেও অভিযোগ করেছেন তিনি।

    বিদেশ থেকে দিল্লি হয়ে কলকাতায় ফিরে অভিষেক যখন কড়া বার্তা দিচ্ছেন, যুবভারতী-কাণ্ডের পরে প্রথম কোনও অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে ইঙ্গিতে মন্তব্য করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ঘটনার পরেই সমাজমাধ্যমে ক্ষমাপ্রার্থনা করে তদন্ত কমিটি গড়ার ঘোষণা করে দিয়েছিলেন তিনি। নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে এ দিন ব্যবসায়ী সম্মেলনের মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য, ‘‘আমাদের কেউ যদি দুষ্টুমি করে, তা হলে আমিও দুষ্টু-মিষ্টি ওষুধ দিয়ে সমস্যা সমাধান করে দিই বা সমাধানের চেষ্টা করি।’’ তাঁর পাশেই ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী তথা বিধাননগরের বিধায়ক সুজিত বসু। সভার একেবারে শেষে স্বভাবসিদ্ধ ঢঙে মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেছেন, ‘‘আমি কিছু দিন আগে মুর্শিদাবাদ সফরে গিয়েছিলাম, সেখানে একটা মেলা হচ্ছিল। আমি যাব ভেবেছিলাম। কিন্তু জানতাম আমি গেলে সেখানে ছবি তোলার জন্য ভিড় হবে। বাপরে বাপ কী ভিড়! সে দিন আর সেখানে ঢুকতে পারিনি।’’ ছবি তোলার ভিড়ের প্রসঙ্গ টেনে মুখ্যমন্ত্রী যুবভারতী-কাণ্ডের দিকে ইঙ্গিত করে থাকতে পারেন বলে অনেকের ধারণা। প্রসঙ্গত, সে দিন যুবভারতীতে তাণ্ডব শুরু হয়ে যাওয়ায় রাস্তা থেকে ফিরে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী।

    প্রশাসন ও শাসক দলের উপরে চাপ বাড়িয়ে বিজেপি বিধায়ক ও সমর্থকদের সঙ্গে নিয়ে এ দিন যুবভারতীতে গিয়েছিলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। পুলিশের তদন্তকারী দল বেরিয়ে যাওয়ার পরে আচমকাই স্টেডিয়াম চত্বরে ঢুকে মাঠে যেতে চান তাঁরা। কিন্তু গেট বন্ধ থাকায় বাইরে দাঁড়িয়ে প্রশাসনিক ব্যর্থতার পাশাপাশি এই অনুষ্ঠান ঘিরে কয়েকশো কোটি টাকার আর্থিক গোলমাল হয়েছে বলে অভিযোগ করে শুভেন্দু বলেন, ‘‘পুলিশ, স্টেডিয়াম কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। নিরপেক্ষ সংস্থাকে দিয়ে তদন্ত করতে হবে।’’ দুই মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস ও সুজিতের গ্রেফতারের দাবি করে তিনি বলেন, ‘‘ধৃতদের (মাঠে গোলমালের ঘটনায় পুলিশ যাদের ধরেছে) নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে।’’ টিকিটের টাকা ফেরতের দাবিতে আন্দোলন হবে বলেও দাবি করেছেন তিনি।

    শহরে ফুটবলের অনন্য তারকা মেসিকে নিয়ে অনুষ্ঠানে অশান্তির জেরে আলোড়ন পড়ে গিয়েছে রাজ্যের রাজনীতিতে। ক্রীড়া দফতর ছাড়তে হয়েছে মন্ত্রী অরূপকে। পাশাপাশি ওই ঘটনার জেরে রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমার-সহ পুলিশ ও প্রশাসনের একাধিক কর্তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপও করা হয়েছে। এই অবস্থাকে সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ও বিপুল আর্থিক দুর্নীতি নিয়ে সরব হয়েছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু। বিধানসভা ভোটের আগে চাপে পড়েই গত দু’দিন কিছুটা রক্ষণাত্মক ছিল শাসক শিবির। দিল্লি থেকে কলকাতায় ফিরে এ দিন সরকারের সেই অবস্থানকেই অস্ত্র করেছেন অভিষেক। এই সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে অভিষেক বলেন, ‘‘সরকার নতজানু হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী নিজে ক্ষমা চেয়েছেন।’’ তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘দেশে আর কোথায় এমন হয়? পদপিষ্ট হয়ে মানুষ মারা যাচ্ছেন, রেল দুর্ঘটনায় মৃত্যু হচ্ছে। কেউ ক্ষমা চেয়েছেন?’’

    বাইরের আক্রমণের জবাবে সুর চড়ালেও ‘ঘরে’ও অভিষেকের বার্তা ছিল স্পষ্ট। পদত্যাগী ক্রীড়ামন্ত্রীর বিরুদ্ধে সে দিন মাঠে মেসিভক্তরা যে অভিযোগ তুলেছিলেন, কার্যত তাকেই মান্যতা দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আদিখ্যেতা দেখাতে গিয়ে যাঁরা মেসিরর অনুরাগীদের নিরাশ করেছেন, তাঁদেরও জবাবদিবি করতে হবে। সারা বছরের টাকা জমিয়ে, পুজোয় নতুন জামা-কাপড় না কিনে অনেকে মেসিকে দেখতে গিয়েছিলেন। দেখতে না পেয়ে তাঁদের হতাশা, ক্ষোভ যথার্থ।’’ তাঁর সংযোজন, দায়ী সকলের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নেবে।

    সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী অবশ্য প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘পুলিশ-প্রশাসনের গাফিলতি অবশ্যই ছিল। তা হলে পুলিশমন্ত্রী ছাড় পান কী ভাবে? টিকিট বিক্রি থেকে শুরু করে খাবার, জল মিলিয়ে একশো কোটি টাকার বেশি কালোবাজারি হয়েছে। সেই কেলেঙ্কারির কী হবে? ছবি তোলার ভিড়ে ওঁর পরিবারের লোকেরাও ছিলেন। সকলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার কথা বলে ভাইপো কি তাঁর পিসিকেও ইঙ্গিত করছেন?’’

    যুবভারতীর বাইরে বিরোধী দলনেতার সঙ্গে এ দিন দেখা গিয়েছে বিজেপি বিধায়ক, প্রাক্তন ক্রিকেটার অশোক দিন্দাকে। মেসিকে দেখতে মাঠে হাজির ছিলেন অশোক। সমাজমাধ্যমে সেই ভিডিয়ো-সহ সরব হয়েছে তৃণমূল। অশোক যদিও বলেছেন, তিনি দেশের হয়ে খেলেছেন। তাই এক জন বিশ্ববন্দিত খেলোয়াড়কে কী ভাবে সম্মান দিতে হয় এবং কতটা দূরত্ব বজায় রাখতে হয়, সেটা তাঁর জানা। এর পরে অশোকের দাবি, তিনি সে দিন মাঠে দূর থেকে একটি ভিডিয়ো তুলেছিলেন মাত্র। শুভেন্দু-সহ বিজেপি বিধায়কেরা হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে মাঠ চত্বরে ‘চোর’, ‘চোর’ স্লোগানও দিয়েছেন।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)