নিজের শিল্প বিক্রি করে দুঃস্থদের সাহায্য প্রশান্তের
আজকাল | ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫
আজকাল ওয়েবডেস্ক: ১২ বছর বয়সে বাবার কাছ থেকে হাতেখড়ি নেওয়া প্রশান্ত অধিকারী আজ একজন সফল শিল্পী। যার নিখুঁত কাঠের কাজ শিল্পপ্রেমীদের মুগ্ধ করেছে প্রতিনিয়ত। প্রশান্তের ছোটবেলা কেটেছে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে। পড়াশোনার পাশাপাশি তাঁর প্রতিভা এবং অধ্যাবসায় তাঁকে এক অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করা প্রশান্ত ছোটবেলায় কাঠের কাজ শেখার সময় মনস্থির করে ছিলেন এলাকার গরিব ছেলেদের বিনামূল্যে হস্তশিল্প ও আর্ট অ্যান্ড ক্রাফ্ট শেখাবেন। সেই কাজ করে চলেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে।
দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে হস্তশিল্পের সঙ্গে যুক্ত প্রশান্ত। বলাগড়ের জিরাটের নেতাজি নগরের বাড়িতে বসেই তিনি কাঠের বিভিন্ন জিনিস গড়েন। এর পাশাপাশি ১০ বছর ধরে আঁকাও শেখান তিনি। কাঠ দিয়ে রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীজি, ক্ষুদিরামের ফাঁসি, ডান্ডি অভিযান, নেতাজির মতো মনীষীদের মূর্তি যেমন তৈরি করেছেন, ঠিক তেমনি বিভিন্ন দেব-দেবী মূর্তিও তৈরি করেছেন। সেই সমস্ত মূর্তি সরকারি হস্তশিল্প মেলায় নিয়ে গিয়ে বিক্রি করেন প্রশান্ত। ১০০ টাকা থেকে শুরু ১৩ হাজার টাকার পর্যন্ত কাঠের মূর্তি রয়েছে তাঁর কাছে। বিভিন্ন হস্তশিল্প মেলায় গিয়ে সেগুলি বিক্রি করে যা উপার্জন হয়,তার একটা অংশ প্রত্যন্ত গ্রামের গরিব ছোট ছোট পড়ুয়াদের বিনামূল্যে রং, পেন্সিল, খাতা, পোশাক-সহ বিভিন্ন জিনিস কিনে দেন শিল্পী প্রশান্ত।
এক মনে কাজ করে চলেছেন। নিজস্ব চিত্র।
প্রশান্তের হস্তশিল্পের সুনাম রয়েছে বিদেশের মাটিতেও। অস্ট্রেলিয়া, সৌদি আরব, বেঙ্গালুরু, মুম্বই, লন্ডন, ইরান-সহ একাধিক জায়গায় পৌঁছে গিয়েছেন এবং জনপ্রিয়তাও অর্জন করেছে। প্রশান্তর ঝুলিতে রয়েছে একাধিক পুরস্কার। জেলা স্তরে পুরস্কার পেয়েছেন ১৪ বার। রাজ্যস্তরে পুরস্কার পেয়েছেন তিন বার। ২০২৪ সালের মার্চ মাসে বারুইপুরে এক্সপেরিমেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটে সরকারি প্রতিনিধি হিসেবে ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাসও করিয়েছিলেন। কাঠ ছাড়াও তিনি থার্মোকল, ফাইবার, রেসিং, প্লাস্টিকের বোতল কেটে বিভিন্ন জিনিস তৈরি করা শেখান তাঁর প্রতিষ্ঠানের শিশুদের।
প্রশান্তের বাবা অরুণের ছিল কাঠের ব্যবসা। পরিবারে অভাব সত্ত্বেও প্রশান্তকে আঁকা শিখিয়েছিলেন অরুণ। আর্ট কলেজেও পড়াশোনা করেছেন তিনি। বলাগড় বিজয়কৃষ্ণ মহাবিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক হওয়ার পর, ২০০৯ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করেন। তাঁর কাছে আঁকা শেখে ২৬২ জন পড়ুয়া। এদের মধ্যে ১৪০ জনের থেকে কোনও ফি নেন না তিনি। আগামী দিনে তাঁর ইচ্ছে রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে পুরস্কার নেওয়া। তার জন্য চলছে প্রস্তুতি।
প্রশান্ত অধিকারীর শিল্প। নিজস্ব চিত্র।
শিক্ষকের এই কাজে খুশি পড়ুয়াদের অভিভাবকরা। উদিতা প্রমাণিক, সুব্রত রায়ের সন্তানরাও আঁকা শেখে তাঁর কাছে। তাঁরা বলেন, “স্যার অন্যান্য শিক্ষকদের মতোই আমাদের সন্তানদের আঁকা শেখায়। কিন্তু কারও কাছ থেকে কোনও পারিশ্রমিক নেয় না। দরিদ্র বাচ্চাদের খাতা, রং, পেন্সিল কিনে দেয়।”
প্রশান্ত বলেন, “ছোটবেলায় আমি দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করেছি। সেই অনুভূতি আমি বুঝি। তাই কোনও গরিব মানুষ যাতে অর্থের জন্য কোনও শিক্ষা থেকে বঞ্চিত না হয় সেই কারণেই আমি বিনা পারিশ্রমিকে গ্রামের ছাত্রছাত্রীদের আঁকার বিভিন্ন সামগ্রিক কিনে দি। এমনকি কেউ যদি জামাকাপড় পরতে না পারে তাদেরকে জামাকাপড় কিনে দিয়েছি।”
তিনি আরও বলেন, “আমার বাবা আমাকে অনেক আর্থিক প্রতিকূলতার মধ্যেও আঁকা ও পড়াশোনা শিখিয়েছিল। আমার হাতে তৈরি সামগ্রী দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় গেছে। অনেকে বাইরে রাজ্যে কাজে গিয়েছেন, তাঁরাও আমার কাছ থেকে কাঠের তৈরি বিভিন্ন জিনিস কিনে নিয়ে গেছেন। এভাবেই পৌঁছে যায় দেশ-বিদেশের মাটিতে। আমার পরিবার আমাকে সাহায্য করে। আমার ইচ্ছে রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পুরস্কার নেওয়া। তার জন্য আমার লড়াই জারি রয়েছে।”