• আকাশে রহস্যময় আলো কি জেমিনিড ফায়ারবল? আগুন লাগার কারণ নিয়ে ধোঁয়াশা
    এই সময় | ২০ ডিসেম্বর ২০২৫
  • এই সময়: উত্তরের আকাশে রহস্যময় আলো দেখে হুলস্থূল পড়ে গিয়েছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জলপাইগুড়ি, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন প্রান্তে এই আলো দেখে আতঙ্কে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন বাসিন্দারা। মুহূর্তের মধ্যে ছবি, ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়। এমনকী, চোপড়ায় রাতে আকাশ থেকে অগ্নিপিণ্ড এসে আগুন লাগিয়ে তছনছ করে দেয় একটি বাড়ি, এমন খবরও ছড়িয়ে পড়ে। কোথাও আকাশ থেকে টপাটপ করে রহস্যময় পাথর পড়েছে বলেও খবর ছড়ায়। কেউ একে ‘ইউএফও’ বলে দাবি করেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, সমস্তটাই গুজব হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এর পিছনে আসল কারণ জানতে প্রশাসনিক স্তর থেকে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে।

    এ দিকে সকলের মনে একটাই প্রশ্ন, ওই রহস্যময় আলো আসলে কী? বিশেষজ্ঞদের মতে, ওই আলো তৈরি হওয়ার পিছনে মেটিওর শাওয়ার বা উল্কাবৃষ্টি মূল কারণ হতে পারে। আকাশে যে ‘আগুনের বল’ দেখা গিয়েছে বলে সোশ্যাল মিডিয়ায় দাবি করা হয়েছে, তা ‘জেমিনিড ফায়ারবল’ হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি বলে মনে করছেন এক্সপার্টরা। মিথুন রাশি বা জেমিনির দিক থেকে আসে বলে একে জেমিনিড ফায়ারবল বলা হয়।

    জানা গিয়েছে, প্রত্যেক বছর ডিসেম্বরের মাঝামাঝি উল্কাবৃষ্টি হয়। তার আগাম আন্দাজও পাওয়া যায়। এ বারেও ১৩–১৭ ডিসেম্বরের মধ্যে বিশ্বজুড়ে উল্কাবৃষ্টি হয়েছে। বৃহস্পতিবার তুর্কির পূর্বাংশের আকাশে একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে প্রচণ্ড গতিতে ‘জেমিনিড ফায়ারবল’ ছুটে যেতে দেখা গিয়েছে। মহাকাশ পর্যবেক্ষণকারীরা এই সময়ে টেলিস্কোপে চোখ রেখে অপেক্ষায় থাকেন, কখন একটা আলোর ঝলকানি দেখা যাবে।

    জলপাইগুড়ি–সহ উত্তরের আকাশে যে আগুনের বল দেখা গিয়েছে, তা ‘জেমিনিড ফায়ারবল’ হতে পারে বলে জানিয়েছেন স্কাই ওয়াচার্স অ্যাসেসিয়েশন অফ নর্থবেঙ্গল (সংক্ষেপে সোয়ান)–এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক দেবাশিস সরকার। তাঁর কথায়, ‘এটি সাধারণ মানুষের কাছে রহস্যময় হলেও মহাকাশ বিজ্ঞান–পিপাসুদের কাছে জলভাত এবং খুবই সাধারণ একটি বিষয়।’ তাঁর ব্যাখ্যা, প্রত্যেক বছর ডিসেম্বরে উল্কাপাত হয়। ভূপৃষ্ঠ থেকে ৪০–৮০ কিলোমিটার উচ্চতায় (হাই অল্টিটিউড) এই ফায়ারবলগুলি অবস্থান করে। বেশির ভাগ ফায়ারবল আকারে ছোট হয়। তার মধ্যে কিছু ফায়ারবল থাকে যেগুলি আকারে বড়। ফায়ারবল যত বড় হবে, তার আলোর তীব্রতাও তত বেশি হবে। উত্তরের আকাশে যেটি দেখা গিয়েছে, সেটি বড় ফায়ারবল হতে পারে। কোথাও ফায়ারবল জেমিনিড হতে পারে, কোথাও উরিসিডও হতে পারে বলে জানিয়েছেন তিনি।

    সামাজিক মাধ্যমে যে ছবি, ভিডিয়ো ছড়িয়েছে তা নিয়ে দেবাশিসের ব্যাখ্যা, ফায়ারবলের কারণে আকাশে যে আলো দেখা যায়, তার স্থায়িত্ব হয় মাত্র তিন থেকে চার সেকেন্ড। ফলে আকাশে আলো দেখে পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে ক্যামেরা চালু করে ভিডিয়ো কিংবা ছবি তুলতে যে সময় ব্যয় হয়, তার অনেক আগেই ওই আলো গায়েব হয়ে যায়। প্রকৃতি বিজ্ঞানের নিয়ম মানলে সাধারণ মোবাইল ক্যামেরায় এর নিখুঁত ভিডিয়ো রেকর্ড করা প্রায় অসম্ভব। একমাত্র বিশেষ ক্যামেরাতেই এটি সম্ভব। তার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়।’ তাঁর মতে, সোশ্যাল মিডিয়ায় যা ছড়িয়েছে, তা অন্য কোনও জায়গায় বিশেষ ক্যামেরায় রেকর্ডেড ছবি–ভিডিয়ো।

    এ দিকে, দক্ষিণ দিনাজপুরের হরিরামপুরে রহস্যজনক বস্তু উদ্ধার নিয়ে তৈরি হয়েছে কৌতূহল। অনেকেরই দাবি, সেটি উল্কাপিণ্ড। শুক্রবার সকালে গোকর্ণ এলাকায় ফাঁকা মাঠ থেকে উদ্ধার হয় ওই বস্তু। সেটি আকাশ থেকে টপকেছে বলেও দাবি করেন বাসিন্দাদের একাংশ। পুলিশ গিয়ে বস্তুটি হরিরামপুর থানায় নিয়ে যায়। বস্তুটি কি আদৌ উল্কাপিণ্ড? দেবাশিসের মতে, ‘উল্কাপিণ্ড যে গতিতে এসে পড়ে, তাতে আশপাশে বিশালাকার গর্ত তৈরি হওয়ার কথা। এ ক্ষেত্রে তেমনটা হয়েছে বলে শুনিনি। তাই এটিকে উল্কাপিণ্ড বলা যায় না। তবে এর কেমিক্যাল কম্পোজিশন এবং ফিজি়ক্যাল টেস্ট করলে ভালো ভাবে বোঝা যাবে।’

    পুলিশ সূত্রে খবর, উদ্ধার হওয়া ওই বস্তুর ওজন ১ কেজি ৬৫০ গ্রাম। দৈর্ঘ্য ৩.৫ এবং প্রস্থ ৪.৬ ইঞ্চি। বস্তুটির গায়ে বেশ কয়েকটি ফুটো রয়েছে। দেবাশিস জানিয়েছেন, যদি সত্যি উল্কাপিণ্ড পড়ে, তার উচ্চতা ১ সেন্টিমিটারের বেশি হলে সেটি সরকারি সম্পত্তি হয়ে যায়। ব্যক্তিগত ভাবে রাখলে তা আইনত অপরাধ। বালুরঘাটের সাংসদ সুকান্ত মজুমদার বলেন, ‘জেলা প্রশাসন যদি বস্তুটি নিয়ে গবেষণা করতে চায়, সে ক্ষেত্রে ইসরোর বিজ্ঞানীদের সঙ্গে যোগাযোগ করব।’ গঙ্গারামপুর মহকুমা পুলিশ আধিকারিক শুভতোশ সরকার জানান, বস্তুটি জেলার মিউজ়িয়ামে রাখার জন্য জেলা প্রশাসনকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। জেলাশাসক বালা সুব্রহ্মনিয়াণ টি বলেছেন, ‘বস্তুটি আসলে কী, তা জানার জন্য বিশেষজ্ঞদের বলা হবে।’

    উত্তর দিনাজপুরের চোপড়া ব্লকের মাঝিয়ালিতে কালিগছ গ্রাম থেকেও আকাশে রহস্যময় আলো দেখা যায়। স্থানীয়দের দাবি, তখনই দ্রুতগতিতে আসা একটি উজ্জ্বল আলোময় বস্তু কালিগছ প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় এসে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আরও একটি উজ্জ্বল বস্তু তীব্র গতিতে ছুটে এসে বিকট শব্দে গণেশ ওরাওঁয়ের বাড়ির উপরে পড়ে। তাঁদের দাবি, এর ফলে ওই বাড়িতে আগুন লাগে। মুহূর্তের মধ্যে গোটা ঘর ছাই হয়ে যায়। প্রায় দু’ঘণ্টার চেষ্টায় স্থানীয় বাসিন্দারাই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। প্রাণহানির ঘটনা না–ঘটলেও অনেক ক্ষতি হয়ে গিয়েছে বলে জানান গণেশ। এই ঘটনার পিছনে কি উল্কাপিণ্ড দায়ী? দেবাশিসের মতে, সাধারণত উল্কাপিণ্ড এসে পড়লে এমনটা ঘটে না। এ ক্ষেত্রে ঠিক কী ঘটেছে, তা তদন্ত হলেই বোঝা যাবে। ওই রাতেই চিনা রকেটের রি–এন্ট্রি হয়েছে বলে সোশ্যাল মিডিয়ায় খবর ছড়ায়। বিশেষজ্ঞরা সেটিকে গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।

  • Link to this news (এই সময়)