• 'ভরসার হাত' সেই শিক্ষাকর্মীরা মুদির দোকানে, ডেলিভারিতে
    এই সময় | ২০ ডিসেম্বর ২০২৫
  • স্নেহাশিস নিয়োগী

    এক সময়ে ওঁরা ছিলেন স্কুলের মুশকিল আসান!

    স্কুলের প্রধান শিক্ষক, সহকারী শিক্ষক, পড়ুয়া এবং তাদের অভিভাবকদের বড় ভরসা। যে কোনও প্রয়োজনেই ডাক পড়ত স্কুলের গ্রুপ সি এবং গ্রুপ ডি কর্মী অমিত, প্রশান্ত, অচিন্ত্য, বিবেকানন্দ, মিন্টু, অভিজিৎদের। স্কুলে পড়ুয়ারা অসুস্থ হলে তাদের বাড়ি পৌঁছে দেওয়া বা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া, শিক্ষক–শিক্ষিকাদের চা দেওয়া, স্টোর রুম থেকে রোজ মিড ডে মিলের চাল, ডাল এবং সবজি বের করে দেওয়া, এমনকী স্কুলের পাশাপাশি শিক্ষক–শিক্ষিকাদের প্রয়োজনেও ব্যাঙ্কে গিয়ে টাকা তোলা এবং জমা দেওয়া — আকছার ব্যস্ত থাকতেন ওঁরা। কিন্তু নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে গত ন’মাস ধরে রাজ্যের ৩,৩৯৪ ‘নন–টেন্টেড’ গ্রুপ সি এবং গ্রুপ ডি কর্মীর চাকরি নেই। স্কুল চলছে। অথচ ওঁরা স্কুল থেকে অনেক দূরে। কেউ মুদির দোকানে, কেউ ডেলিভারি বয়, আবার কেউ হার্ডওয়্যারের দোকানে কাজ করছেন।

    ২০১৬–এর প্যানেলে ১৮ লক্ষ চাকরিপ্রার্থীর সঙ্গে লড়ে স্কুলে–স্কুলে গ্রুপ সি এবং ডি’র চাকরি পেয়েছিল ওঁরা। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির জেরে শীর্ষ আদালতের নির্দেশে আচমকাই স্থায়ী চাকরি হারিয়ে মাঝবয়সে ওঁদের ঘাড়ে চেপে বসেছে সংসারের চাপ। সুপ্রিম কোর্টে মধ্যশিক্ষা পর্ষদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ‘নন–টেন্টেড’ শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ আট মাস বৃদ্ধিতে গ্রুপ সি, গ্রুপ ডি কর্মীদের হাহাকার আরও বেড়েছে।

    মুর্শিদাবাদের লালনগর হাইস্কুলে ২০১৯–এর ১ ফেব্রুয়ারি গ্রুপ সি–র চাকরি পেয়েছিলেন প্রশান্ত সরকার। বহরমপুর শহর থেকে ৫০ কিমি দূরে চররাজাপুর গ্রামে বাড়ি। নিজের একটি বৈদ্যুতিক পণ্যের দোকানও ছিল। সরকারি চাকরি পেয়ে সব বিক্রি করে স্কুলে যোগ দিয়েছিলেন। ছ’বছর ধরে কিডনির অসুখে আক্রান্ত প্রশান্ত। বাড়ির জন্য ২৩ লাখ টাকা লোন, মেয়ে ২০২৭–এ মাধ্যমিক দেবে, ছেলে ক্লাস এইটে পড়ে। এপ্রিলে স্কুলের চাকরি চলে যাওয়ার পরে এখন বহরমপুরের বান জেটিয়ায় হার্ডওয়্যারের দোকানে সামান্য টাকায় কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। ঋণ শোধ, চিকিৎসা এবং ছেলেমেয়ের পড়াশোনা নিয়ে ঘুম ছুটেছে প্রশান্তর। একই অবস্থা হুগলির আরামবাগের মৈগ্রাম হাইস্কুলের প্রাক্তন গ্রুপ সি কর্মী অচিন্ত্য মল্লিকের। চাকরি চলে যাওয়ায় বাড়ির ইএমআই ও অসুস্থ মায়ের ওষুধ মিলিয়ে মাসে ২০ হাজার টাকার খরচ। তিন বছরের মেয়েকে বড় করাই এখন চ্যালেঞ্জ। তাই বাধ্য হয়ে স্থানীয় মুদির দোকানে কাজ নিয়েছেন।

    উত্তর ২৪ পরগনার চৌবেড়িয়া গ্রামের বিবেকানন্দ ঘটকের অবস্থা আরও খারাপ। তিনি পশ্চিম মেদিনীপুরের আজবপুর জুনিয়র হাইস্কুলের গ্রুপ ডি কর্মচারী ছিলেন। চাকরি হারিয়ে রোজ ভোর তিনটেয় ঘুম থেকে উঠে চাষিদের থেকে আনাজ কিনে সীমান্তবর্তী পাঁচপোতা ও ঝাউডাঙ্গার বাজারে গিয়ে সেগুলো বেচে সংসার চালান। টানাটানির সংসারে তিন বছরের ছেলেকে এখনও স্কুলে পাঠাতে পারেননি। বিবেকানন্দের আক্ষেপ, ‘এমনটা হবে জানলে বিয়েই করতাম না।’ মধ্যমগ্রামের মির্জাপুর হাইস্কুলের প্রাক্তন গ্রুপ সি কর্মী অভিজিৎ তাঁতি মস্তিষ্কের জটিল অসুখে আক্রান্ত। টাকার অভাবে এখন চিকিৎসাই করাতে পারেন না। বাড়ির কাছাকাছি ওষুধের দোকানে পার্টটাইম ডেলিভারি বয়ের কাজ করে কোনও মতে সংসার চালাচ্ছেন। অথচ স্কুলের চাকরি পাওয়ার আগে একটি বিমান সংস্থায় এজেন্টের মাধ্যমে কাস্টমার সার্ভিস কেয়ারে কর্মরত ছিলেন। মাস গেলে হাতে ২০–২২ হাজার টাকা আসত। এখন সব হারিয়ে ডেলিভারি বয়ের কাজই ভরসা। সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলে শিক্ষাকর্মীর চাকরি ছিল। তাই ভরসা করে বোনের বিয়ে, বাড়ি তৈরি এবং শারীরিক অসুস্থতার জন্য মোটা টাকার ঋণ নিয়েছিলেন। এখন সেই চাকরি চলে যাওয়ায়, বৃদ্ধ বাবা–মাকে নিয়ে ঘোর অনিশ্চয়তার মুখে অভিজিৎ।

    চাকরিহারা ‘নন–টেন্টেড’ গ্রুপ সি কর্মী অমিত মণ্ডলের কথায়, ‘রাজ্য সরকার, এসএসসি এবং মধ্যশিক্ষা পর্ষদের দুর্নীতির দায়ে আমাদের চাকরি গিয়েছে। ন’মাস কর্মচ্যুত। কিন্তু এই সরকার আমাদের জন্য কিছুই ভাবছে না!’

  • Link to this news (এই সময়)