• সনজীদা আপার পীঠস্থানের এই পরিণতি মানতে পারছি না: মালা দেব বর্মন
    এই সময় | ২১ ডিসেম্বর ২০২৫
  • মালা দেব বর্মন

    শুক্রবার সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরে টেলিভিশনের পর্দায় ছায়ানট ধ্বংস করার ছবি দেখে নিজেকে আর সামলে রাখতে পারিনি। শান্তিনিকেতনের আদলে ছায়ানট গড়ে তুলেছিলেন সনজীদা আপা (সনজীদা খাতুন)। তাঁর ছবি ফালা ফালা করে কেটে দেওয়া হয়েছে। তবলা, হারমোনিয়াম, এসরাজ–সহ অন্য বাদ্যযন্ত্রগুলিও ভেঙে চুরমার করে দেওয়া হয়েছে।

    ছবিগুলো কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি, হাউহাউ করে কেঁদেছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, লালন ফকিরকে মেনে নিতে পারছে না আজকের বাংলাদেশের এই ‘মবোক্র্যাসি’–র কুশীলবরা! আমাদের সবার প্রিয় আপার স্বপ্নের অ্যাকাডেমি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিল।

    শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে স্নাতক স্তরের পড়াশোনা করার সময়ে সনজীদা খাতুনকে প্রথম দেখি। যদিও তিনি আমাদের থেকে অনেক সিনিয়র ছিলেন। কিন্তু ওঁর এবং আমার স্থানীয় অভিভাবক ছিলেন একই ব্যক্তি। সেই সুবাদে প্রিয় আপার সঙ্গে মাঝেমধ্যেই দেখা হতো। খুব কাছ থেকে পেয়েছি ওঁর সান্নিধ্য। আপা শান্তিনিকেতন থেকে ডক্টরেট করার পরে ডি–লিট করেছিলেন। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। সেই সময়ে আগে থেকে ফোনে অনুমতি নিয়ে সনজীদা আপার সঙ্গে দেখা করি।

    বিশ্বভারতীতে চারুকলা বিভাগে ছিলেন লীনা তাপসী খান। পরে তিনি চলে গিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর বাড়িতেও গিয়েছিলাম। লীনার বাড়ি থেকে আপার বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয়। আসলে আমি লীনাকেই ব্যক্তিগত ভাবে অনুরোধ করেছিলাম, বাংলাদেশে যাব অথচ সনজীদা আপার সঙ্গে দেখা করব না, সেটা হতেই পারে না। লীনার থেকে ফোন নম্বর নিয়ে আমি আপাকে নিজের ইচ্ছার কথা বলতেই উনি বললেন, তুমি চলে এসো।

    লীনার ছেলে আনন্দ আবার ছিল আপার ছায়নটের ছাত্র। ও বাদ্যযন্ত্রের তালিম নিত সেখানে। ওই আনন্দ আমাকে আপার বাড়িতে নিয়ে যায়। গিয়ে দেখলাম, ছায়ানট সংস্থায় ছেলেমেয়েরা সঙ্গীতের তালিম নিচ্ছে। দৃশ্যটা আমার কাছে ছিল খুব আনন্দ এবং গর্বের বিষয়। তখনও তো ছায়নট সে ভাবে বড় কিছু করে উঠতে পারেনি। পরবর্তী সময়ে সেই সংস্থা এত সুন্দর ভাবে গড়ে তোলা হয় যে, সাধারণ মানুষ এমনিই সেই সংস্কৃতির পীঠস্থান দেখতে আসতেন।

    আপার সঙ্গে ওঁর বাড়িতে নানা বিষয় নিয়ে কথা হয়েছিল। উনিই একদিন গানের ক্লাস চলাকালীন আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আমি তো সেই প্রস্তাব পেয়ে আহ্লাদে আটখানা। চলেও গিয়েছিলাম। সেই সময়ে পুরোদমে গানের ক্লাস চলছে। ওখানে গান শিখিয়েছেন অদিতি মহসিন।

    তারপর থেকে আমি বহু বার পয়লা বৈশাখে ছায়ানটে গিয়ে গান গেয়েছি। ২১ জুলাই ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানেও গান গেয়েছি। এ ছাড়া বাংলাদেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছি গায়িকা হিসেবে। বাংলাদেশে শিল্পী মহলে আমার নাম প্রত্যেকেই জানেন।

    যত বার বাংলাদেশে গিয়েছি, ছায়ানটে একবার হলেও পা রেখেছি। ওটাই তো আমার কাছে একমাত্র ধ্যানজ্ঞান ছিল। কোভিড অতিমারির আগে শেষ বার বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। সেই বাংলাদেশের সঙ্গে আজকের দেশটাকে কিছুতেই মেলাতে পারছি না। বাংলা সংস্কৃতিচর্চার পীঠস্থানের পরিণতি কী এমন হতে পারে! কিছুতেই মানতে পারছি না। কষ্টে দমটা যেন বন্ধ হয়ে আসছে।

    (লেখিকা বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী)

  • Link to this news (এই সময়)