কলকাতার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে বিশ্বখ্যাত ফুটবল তারকা লিয়োনেল মেসির সফরকে কেন্দ্র করে যে নজিরবিহীন বিশৃঙ্খলা ও আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, সোমবার কলকাতা হাই কোর্টে তার শুনানি সম্পন্ন হলো। ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি সুজয় পাল এবং বিচারপতি পার্থসারথি সেনের ডিভিশন বেঞ্চে এই মামলার রায়দান আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে। রাজ্য সরকার, আয়োজক শতদ্রু দত্ত এবং মামলাকারীদের আইনজীবীদের মধ্যে বাদানুবাদে উঠে এল একাধিক চাঞ্চল্যকর তথ্য।
আয়োজকের সাফাই: ‘আমি কথা রেখেছি’
যুবভারতীকাণ্ডের অন্যতম মূল অভিযুক্ত তথা অনুষ্ঠানের আয়োজক শতদ্রু দত্তের আইনজীবী বিশ্বজিৎ মান্না আদালতে দাবি করেন, আয়োজক হিসেবে মেসির মতো তারকাকে কলকাতায় নিয়ে আসার যে প্রতিশ্রুতি তাঁর মক্কেল দিয়েছিলেন, তা তিনি পালন করেছেন। শতদ্রু দত্তর পক্ষ থেকে জানানো হয়, মেসির এই সফর শুধু কলকাতায় নয়, হায়দরাবাদ, মুম্বই এবং দিল্লিতেও হয়েছে এবং সেখানে কোনও বিশৃঙ্খলা হয়নি।
শতদ্রুর আইনজীবীর প্রধান যুক্তি ছিল, মাঠে অতিরিক্ত লোক প্রবেশের দায় আয়োজকদের নয়, বরং পুলিসের। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, 'আমার কাজ ছিল মেসিকে কলকাতায় নিয়ে আসা, আমি এনেছি। যুবভারতীর গেটে পুলিস মোতায়েন ছিল। পাস ছাড়া কাউকে প্রবেশ করতে না দেওয়ার দায়িত্ব ছিল তাদের। অতিরিক্ত লোক কী ভাবে মাঠে ঢুকল, সেই দায় কি আয়োজকের?' তিনি আরও অভিযোগ করেন, খোদ পুলিসকর্মীরাও ডিউটি ছেড়ে মেসির সঙ্গে ছবি তুলতে ব্যস্ত ছিলেন। এমন কি জলের বোতল মাঠে প্রবেশের ক্ষেত্রেও স্টেডিয়াম কর্তৃপক্ষ ও পুলিসের নজরদারির অভাবকে দায়ী করেন তিনি।
রাজ্যের অবস্থান: ‘আমরা রিকভারি এজেন্ট নই’
রাজ্য সরকারের পক্ষে বর্ষীয়ান আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় সওয়াল করেন যে, এই অনুষ্ঠানের অব্যবস্থার জন্য সরকার ইতিবাচক পদক্ষেপ করেছে। তিনি জানান, ঘটনার গুরুত্ব বুঝে মুখ্যমন্ত্রী নিজে ক্ষমা চেয়েছেন, যা নজিরবিহীন। প্রশাসনিক তৎপরতার প্রমাণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন যে, ঘটনার পরেই ডিজি রাজীব কুমার এবং সিপি মুকেশ কুমারকে শোকজ করা হয়েছে এবং ডিসিপি অনীশ সরকারকে সাসপেন্ড করা হয়েছে।
রাজ্যের তরফে আরও দাবি করা হয় যে, আয়োজকরা পুলিসের কাছে সঠিক তথ্য দেয়নি। মেসিকে কেন্দ্রের তরফে ‘জেড ক্যাটেগরি’র নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছিল এবং এনএসজি কমান্ডোরা তাঁর দায়িত্বে ছিলেন। সিআইএসএফ এবং রাজ্য পুলিসের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ছিল বলেও রাজ্য দাবি করে। টিকিটের টাকা ফেরতের প্রসঙ্গে রাজ্যের স্পষ্ট জবাব, 'সরকার কোনো টিকিট বিক্রি করেনি, সবটাই করেছে আয়োজকরা। আমরা টাকা উদ্ধারের রিকভারি এজেন্ট নই।'
বিরোধীদের দাবি: ইডি বা কেন্দ্রীয় তদন্তের প্রয়োজন
রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী এবং অন্য দুই মামলাকারীর তরফে এই ঘটনায় কেন্দ্রীয় সংস্থাকে দিয়ে তদন্ত করানোর জোরালো দাবি তোলা হয়েছে। তাঁদের আইনজীবীদের প্রশ্ন, মেসিকে অগ্রিম হিসেবে যে ৬০-৬৫ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল, তার উৎস কী? সেই সময় তো টিকিটই বিক্রি হয়নি। শুভেন্দুর আইনজীবীর সওয়াল, এই অনুষ্ঠানের আড়ালে বড় কোনো আর্থিক লেনদেন বা দুর্নীতি লুকিয়ে থাকতে পারে, তাই ইডি (ED) বা এসএফআইও (SFIO) দিয়ে তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।
মামলাকারীদের পক্ষ থেকে আইনজীবী সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায় প্রশ্ন তোলেন যে, এটি একটি চ্যারিটি ম্যাচ হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সেই টাকা শেষ পর্যন্ত কোথায় গেল? এছাড়াও একটি বিশেষ ক্লাবের মাঠে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়, যার সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের এক সদস্য যুক্ত বলে দাবি করেন শুভেন্দুর আইনজীবী।
আদালতের পর্যবেক্ষণ ও পাসের জটিলতা
শুনানির সময় পাসের বণ্টন নিয়ে বিস্তর বাদানুবাদ হয়। রাজ্য জানায়, মোট ৮২টি ‘ক্লোজ প্রক্সিমিটি’ (CP) পাস দেওয়া হয়েছিল, যার মধ্যে আইবি অফিসার এবং উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্তারাও ছিলেন। এর জবাবে বিচারপতি পার্থসারথি সেন প্রশ্ন করেন, “আপনারা কি নিজেরা খতিয়ে দেখে এই পাস দিয়েছিলেন? নাকি আয়োজকরা যা চেয়েছে তা-ই দিয়েছেন?” রাজ্য জানায়, সময় কম থাকায় সব খতিয়ে দেখা সম্ভব হয়নি।
অন্যদিকে, একটি পার্কে মেসির মূর্তি বসানো নিয়েও আদালত প্রশ্ন তোলে। বিচারপতি জানতে চান, সরকারি জমিতে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কীভাবে মূর্তি বসানো সম্ভব? রাজ্যের তরফে জানানো হয়, মন্ত্রী সুজিত বসু ব্যক্তিগত উদ্যোগে এটি করেছেন এবং এ নিয়ে এখনও কোনো আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জমা পড়েনি।
যুবভারতীকাণ্ডের এই মামলা এখন রায়ের অপেক্ষায়। একদিকে আয়োজক ও রাজ্য সরকার একে অপরের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করছে, অন্যদিকে কেন্দ্রীয় তদন্তের দাবিতে সরব বিরোধীরা। মেসির মতো একজন আন্তর্জাতিক ফুটবল তারকাকে ঘিরে এই ‘মেগা ইভেন্ট’ শেষ পর্যন্ত আইনি লড়াই এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতার এক জটিল দলিলে পরিণত হয়েছে। হাইকোর্টের চূড়ান্ত রায়ের ওপরই নির্ভর করছে পরবর্তী তদন্তের অভিমুখ এবং কয়েক হাজার সাধারণ দর্শক তাঁদের টিকিটের টাকা ফেরত পাবেন কি না, তার উত্তর।