চিত্রদীপ চক্রবর্তী
একটা অ্যাকাউন্ট। অভিযোগও একটা। আর তার জেরে ফ্রিজ় হয়ে গেল দেশের ৩৫ হাজার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট!
গত কয়েক বছর ধরে রকেটের দ্রুততায় বেড়ে চলা সাইবার অপরাধের ঘটনায় এই প্রথম চেন সিস্টেমে একসঙ্গে এতগুলি ব্যাঙ্ক খাতা বাজেয়াপ্ত করলেন গোয়েন্দারা। এর মধ্যে এ রাজ্যের অন্তত এক হাজার অ্যাকাউন্ট রয়েছে। ৪ কোটি ৪৩ লক্ষ টাকা সাইবার প্রতারণার মূল ঘটনাটি ফরিদাবাদে ঘটলেও এর রেশ পড়েছে সারা দেশে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, এর মধ্যে বহু অ্যাকাউন্টের মালিকের সঙ্গে প্রতারণার কোনও সরাসরি যোগ নেই। প্রতারিত টাকার খুব সামান্য অংশ তাঁদের অ্যাকাউন্ট দিয়ে লেনদেন হওয়ার কারণেই সেগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখনও পর্যন্ত দেশের মোট ১০টি রাজ্যের ৩৫ হাজারের বেশি অ্যাকাউন্টে ওই প্রতারণার টাকা ঢুকেছে বলে পুলিশের দাবি।
দিঘায় সমুদ্র লাগোয়া মাছ ভাজার ছোট দোকান রয়েছে রমেশ মান্নার। তাঁর কথায়, ‘একজন ক্রেতা ঘুরতে এসে আমার কাছে চিংড়ি মাছ ভাজা খেয়েছিলেন। এর পরে ইউপিআই–এর মাধ্যমে ৮২৬ টাকা পাঠান। দু’দিন পরে ব্যাঙ্ক থেকে মেসেজ আসে — সাইবার অপরাধের সঙ্গে যুক্ত টাকার লেনদেন হওয়ায় আমার অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ় করা হয়েছে। এক মাসেরও বেশি সময় ধরে ব্যাঙ্ক আর আইনজীবীর কাছে ছোটাছুটি করছি।’
একটি নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্টের বিরুদ্ধে সাড়ে চার কোটি টাকা প্রতারণার অভিযোগটি দায়ের করা হয়েছিল ফরিদাবাদের এনআইটি থানায়। পুলিশ তদন্তে নেমে ওই অ্যাকাউন্ট এবং তার সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ় করতে শুরু করে। থানার ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক জিতেন্দ্র কুমারের দাবি, ‘ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট পুনরায় চালু করার আবেদন নিয়ে প্রতি সপ্তাহে গড়ে ১০–১২টি করে অনুরোধ আসছে। অনেকে এসে কান্নাকাটি করছেন। এঁদের কারও অ্যাকাউন্টে মাত্র ২০০ বা ৫০০ টাকা করে ঢুকেছিল। তাতেই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ় করে দেওয়া হয়েছে। কয়েকজন অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়ার জন্য হাইকোর্টের দ্বারস্থও হয়েছেন।’ ওই পুলিশ আধিকারিকের ব্যাখ্যা, ‘সাইবার অপরাধের অভিযোগ দায়ের হলেই স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় সংশ্লিষ্ট সমস্ত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ় করে দেওয়া হয়, যাতে অভিযুক্তরা টাকা তুলতে বা সরিয়ে ফেলতে না পারে। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ঝাড়াই–বাছাইয়ের আগে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। ফলে অনেক নিরীহ মানুষও এই ফাঁদে জড়িয়ে পড়েন।’
ফরিদাবাদের ক্ষেত্রে পুলিশের কাছে অভিযোগ আসে, বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে ইনভেস্টমেন্টের লোভ দেখিয়ে কয়েক কোটি টাকা প্রতারণা করেছে একটি চক্র। তাদের মাধ্যমে সেই বিপুল টাকা জমা করা হয়েছে একটি ‘মিউল অ্যাকাউন্ট’ অর্থাৎ ভাড়া নেওয়া ব্যাঙ্ক খাতায়। তদন্তকারীরা প্রথম অ্যাকাউন্টটি বন্ধ করার পরে দেখা যায়, সেখান থেকে মোটা অঙ্কের টাকা উত্তরপ্রদেশ, বিহার, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, পশ্চিমবঙ্গ, দিল্লি, হিমাচলপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড ও কর্নাটকের বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয়েছে। আবার ওই অ্যাকাউন্টগুলি থেকে টাকা গিয়েছে বিভিন্ন রাজ্যের একাধিক ছোট ব্যবসায়ী বা দোকানদারের কাছে, যাঁরা গ্রাহকদের থেকে ডিজিটাল পেমেন্ট গ্রহণ করেছিলেন। এঁদের প্রত্যেকের সেই অ্যাকাউন্টগুলি অস্থায়ী ভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
যেমন, মুম্বইয়ের আন্ধেরি ওয়েস্ট এলাকার ব্যবসায়ী সুধীর ভোঁসলে মুদির দোকানি। কিছু দিন আগে এক গ্রাহক এসে পাঁচ কেজি চাল নিয়ে ইউপিআই–এর মাধ্যমে পেমেন্ট করেন। তাঁর অ্যাকাউন্টও ফ্রিজ় হয়ে গিয়েছে। কারণ, ওই কাস্টমারের অ্যাকাউন্টেও সম্ভবত ইনভেস্টমেন্ট ফ্রডের টাকা কোনও ভাবে ঢুকেছিল। সুধীরের বক্তব্য, ‘ওই ভদ্রলোককে আমি চিনি না। কোনও দোকানদারের পক্ষেই বোঝা সম্ভব নয় কোনও ক্রেতার ইউপিআই ট্রান্সফার প্রতারণার সঙ্গে যুক্ত কি না। স্থানীয় পুলিশ এবং ব্যাঙ্ককে চিঠি দিয়েও আমার অ্যাকাউন্ট চালু করা যায়নি।’
এ রকম একটি–দু’টি করে ১০টি রাজ্যের ৩৫ হাজার অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ় করা হয়েছে গত এক মাসে। পুলিশ সূত্রের খবর, পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা, বর্ধমান, শিলিগুড়ি, পূর্ব মেদিনীপুর, বীরভূম, মুর্শিদাবাদের মতো জেলায় এখনও পর্যন্ত মোট এক হাজার অ্যাকাউন্টে ফ্রিজ় করা হয়েছে। এদের মধ্যে বেশির ভাগ ব্যবসায়ী। এবং এই পেমেন্টগুলি করা হয়েছে কোনও পেট্রোল পাম্প, হোটেল অথবা খাবারের দোকানে। অনেকেই অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়ার জন্য আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন।
সাইবার বিশেষজ্ঞ কিঞ্জল ঘোষ বলেন, ‘সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বলা হয়েছে পুরো অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ় করা যাবে না। যে অঙ্কের প্রতারণা হয়েছে, শুধু সেইটুকু অংশই ফ্রিজ় করে রাখা যাবে। ফলে যাঁদের অ্যাকাউন্ট আটকে গিয়েছে, তাঁরা আদালতে গেলে সুবিচার পাবেন।’