বীরভূমের মাটির নীচে লুকিয়ে থাকা হাজার বছরের বিস্ময়
দৈনিক স্টেটসম্যান | ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫
ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ দপ্তরের কলকাতা সার্কেলের উদ্যোগে দীর্ঘ প্রায় এক বছর ধরে চলা খননকার্যের শেষে এই আবিষ্কার ঘিরে উত্তেজনা তুঙ্গে। প্রত্নতত্ত্ব বিশেষজ্ঞদের মতে, এই মন্দির কেবল একটি ধর্মীয় স্থাপনা নয়, বরং পাল ও সেন যুগের সন্ধিক্ষণের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় চর্চার গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
ভাদীশ্বর গ্রামের এই ঢিবিটি স্থানীয়দের কাছে বহুদিন ধরেই পরিচিত ছিল। কেউ কেউ একে ‘পুরনো ঢিবি’ বলেই জানতেন। তবে তার নীচে যে কোনও স্থাপত্য লুকিয়ে থাকতে পারে, সেই ধারণা থেকেই ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ দপ্তর এখানে সমীক্ষা চালায়। প্রাথমিক সমীক্ষায় মাটির তলায় ইটের গাঁথুনি ও পোড়ামাটির ভগ্নাংশ নজরে আসতেই শুরু হয় পূর্ণাঙ্গ খনন।
খননের মূল লক্ষ্য ছিল, অতীতের নিদর্শন উদ্ধার করে তার সময়কাল ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব নির্ধারণ করা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঢিবির স্তর খুলতে খুলতে যে কাঠামো সামনে আসে, তা দেখে বিস্মিত হন অভিজ্ঞ প্রত্নতত্ত্ববিদরাও।
খননে পাওয়া মন্দিরটির গঠন একেবারেই ব্যতিক্রমী। মন্দিরটি মোট পাঁচটি স্তরে নির্মিত এবং প্রতিটি স্তরের কাঠামো আলাদা জ্যামিতিক রূপে গড়ে তোলা হয়েছিল।
সবচেয়ে নীচের স্তরটি সম্পূর্ণ গোলাকৃতি। তার উপর দ্বিতীয় স্তরে দেখা যায় ত্রিকোণাকৃতি নির্মাণ। তৃতীয় স্তরে ফের গোলাকৃতি কাঠামো, চতুর্থ স্তরে আবার ত্রিকোণ এবং সবশেষে উপরের স্তরটি তুলনামূলক ছোট আকারের গোলাকৃতি রূপে নির্মিত।
স্তর যত উপরের দিকে উঠেছে, ততই মন্দিরের আকার ছোট হয়েছে। এই ধরনের পর্যায়ক্রমিক স্তরবিন্যাস ও জ্যামিতিক বৈচিত্র্য বাংলার মন্দির স্থাপত্যে অত্যন্ত বিরল। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই গঠন শুধু নান্দনিকতার জন্য নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে পারে তৎকালীন ধর্মীয় বিশ্বাস ও তন্ত্রসাধনার প্রতীকী ভাবনা।
মন্দিরের আশপাশের খনন এলাকা থেকে বিপুল পরিমাণ পোড়ামাটির সামগ্রী উদ্ধার হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে নজরকাড়া নিদর্শন হলো বিভিন্ন আকৃতির পোড়ামাটির ধুনুচি।
এই ধুনুচিগুলির নকশা ও গঠন বর্তমান সময়ে ব্যবহৃত ধুনুচির সঙ্গে মিল খায় না। উপরের অংশ কিছুটা ভাঙা হলেও নিচের দিকের কাঠামো স্পষ্ট। প্রতিটি ধুনুচির ধরার হ্যান্ডেল সোজা এবং নিচের দিকে গোলাকৃতি রিং যুক্ত, যাতে তা স্থির ভাবে বসানো যায়। একই ধরনের নয়, বরং বিভিন্ন মাপ ও নকশার একাধিক ধুনুচি মিলেছে, যা ইঙ্গিত দেয় যে সেগুলি নিয়মিত ধর্মীয় আচার ও ধূপধুনোর কাজে ব্যবহৃত হতো।
ধুনুচির পাশাপাশি পাওয়া গিয়েছে পোড়ামাটির বাটি, গামলা, পাত্র, পুঁথি সংরক্ষণের পাত্র এবং দৈনন্দিন ব্যবহারের নানা সামগ্রী। এই সমস্ত নিদর্শন থেকে তৎকালীন মানুষের জীবনযাত্রা, ধর্মাচরণ এবং শিল্পরুচির একটি স্পষ্ট ছবি উঠে আসে।
খননকার্যের প্রাথমিক বিশ্লেষণে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ দপ্তরের বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই মন্দিরটি পাল যুগের শেষ পর্ব এবং সেন যুগের শুরুর সময়কালে নির্মিত। অর্থাৎ, এর বয়স প্রায় এক হাজার বছর।
এই সময়কাল বাংলার ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাল যুগে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব থাকলেও সেন যুগে ব্রাহ্মণ্য হিন্দু ধর্মের প্রাধান্য বাড়তে শুরু করে। এই মন্দিরের স্থাপত্য ও নিদর্শন সেই রূপান্তরের সাক্ষী বলে মনে করছেন গবেষকরা।
ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ দপ্তরের কলকাতা সার্কেলের সুপারিন্টেন্ডেন্ট ডঃ রাজেন্দ্র যাদব জানান, খননকার্য ইতিমধ্যেই সম্পূর্ণ হয়েছে। প্রাথমিক রিপোর্ট অনুযায়ী, এই মন্দির বাংলার প্রাচীন স্থাপত্য ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।
তাঁর কথায়, ‘এই ধরনের বহুস্তর ও জ্যামিতিক বৈচিত্র্যপূর্ণ মন্দির কাঠামো বাংলায় খুব কমই পাওয়া যায়। এটি শুধু স্থাপত্য নয়, তৎকালীন ধর্মীয় ও সামাজিক চেতনার প্রতিফলন।’
খনন সংক্রান্ত বিস্তারিত রিপোর্ট ইতিমধ্যেই দিল্লিতে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ দপ্তরের ডিরেক্টরের কাছে পাঠানো হয়েছে। সেই রিপোর্ট প্রকাশিত হলে এই আবিষ্কারের ঐতিহাসিক গুরুত্ব আরও সুস্পষ্ট হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বীরভূম জেলা এমনিতেই তার সমৃদ্ধ ইতিহাস ও সংস্কৃতির জন্য পরিচিত। এই আবিষ্কার সেই ঐতিহ্যকে আরও সমৃদ্ধ করল। স্থানীয় ইতিহাসবিদদের মতে, ভাদীশ্বরের এই মন্দির ভবিষ্যতে বাংলার প্রাচীন ধর্মীয় স্থাপত্য নিয়ে গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে।
এখন প্রশ্ন উঠছে, এই মন্দিরকে ঘিরে পর্যটন ও সংরক্ষণের পরিকল্পনা কী হবে। প্রত্নতত্ত্ব দপ্তরের তরফে জানানো হয়েছে, রিপোর্ট চূড়ান্ত হলে সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
মাটির নীচে চাপা পড়ে থাকা ইতিহাস যে এখনও কত বিস্ময় লুকিয়ে রেখেছে, বীরভূমের ভাদীশ্বর গ্রামের এই আবিষ্কার তারই এক জীবন্ত প্রমাণ।