প্রবীর চক্রবর্তী: 'অসঙ্গতির তালিকা প্রকাশ করুন নয়তো ক্ষমা চান': নির্বাচন কমিশনকে চরম হুঁশিয়ারি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে ভোটার তালিকা যাচাই বা এসআইআর (SIR) প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে যুদ্ধংদেহী মেজাজে অবতীর্ণ হলেন তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। আগামী ৩১ ডিসেম্বর এক প্রতিনিধি দল নিয়ে তিনি দিল্লি যাচ্ছেন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমারের সঙ্গে দেখা করতে। তাঁর সাফ কথা, তথাকথিত 'লজিক্যাল ডিসক্রিপেন্সি' (যুক্তিগ্রাহ্য অসঙ্গতি) নামে ১ কোটি ৩৬ লক্ষ ভোটারকে চিহ্নিত করার যে দাবি কমিশন করছে, তার স্বচ্ছ তালিকা জনসমক্ষে আনতে হবে।
অভিষেক প্রশ্ন তুলেছেন, যেখানে বিএলও-রা বাড়ি বাড়ি ঘুরে এক মাসেও কাজ শেষ করতে পারছেন না, সেখানে কমিশন কোন জাদুবলে এক দিনে বা এক ঘণ্টায় এত বিপুল সংখ্যক ভোটারের তথ্যে গরমিল খুঁজে পেল? তাঁর অভিযোগ, বিজেপি নেতাদের 'এক কোটি বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা' থাকার দাবিকে মান্যতা দিতেই কমিশন এই ষড়যন্ত্র করছে। তিনি পরিসংখ্যান তুলে ধরে দেখান যে, ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদের হার বাংলায় (৫.৭৯%) গুজরাট, তামিলনাড়ু বা ছত্তিসগড়ের তুলনায় অনেক কম। তাসত্ত্বেও কেন শুধু বাংলার ওপর এসআইআর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তা নিয়ে তিনি বৈষম্যের অভিযোগ তোলেন।
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, তাঁদের কাছে ডিজিটাল এভিডেন্স এবং হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটের স্ক্রিনশট রয়েছে। বিশেষ করে সীমা খন্না নামে এক আধিকারিকের ভূমিকা নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন। তৃণমূলের দাবি, সফটওয়্যারের ত্রুটির কথা কবুল করা হলেও মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে। এই সমস্ত প্রমাণ তাঁরা সুপ্রিম কোর্টে জমা দেবেন। তিনি হুঙ্কার দিয়ে বলেন, 'জীবিত ভোটারদের মৃত দেখানো হয়েছে। আপনারা এসআইআর করে বাংলা দখল করতে চেয়েছেন, আর বাংলার মানুষ এফআইআর করে গণতান্ত্রিক জবাব দেবে।'
তিনি বলেন, কোন সফটওয়্যার কোন জাদুকাঠিতে ডাকা হচ্ছে হিয়ারিঙের জন্য? কাকলি ঘোষ দস্তিদার জনপ্রতিনিধি কিন্তু তাঁর ছেলেদের নাম নেই। কমিশন আন্ডারটেকিং দিক এবার। আপনি আচরি ধর্ম। এই সব ঘটনা থেকে ওদের অবস্থান স্পষ্ট। বিজেপির পলিটিক্স হচ্ছে লাইনে দাঁড় করানো। মানুষকে প্রতিকূলতায় ফেলা। একটা AERO পক্ষে সম্ভব ২০০ জনকে হিয়ারিং করা? আসলে ওদের পরিকল্পনা নেই। এরা চাটুকারিতা, তল্পিবাহকতা ছাড়া কিছু করেনি।
গত নভেম্বর মাসে তৃণমূলের প্রতিনিধি দল কমিশনে গেলেও কোনো সদুত্তর পায়নি বলে অভিযোগ অভিষেকের। তিনি জানান, কমিশনের এই অপরিকল্পিত কাজের চাপে ইতিমধ্যেই ৫১ জন আত্মঘাতী হয়েছেন, যার মধ্যে ৫ জন বিএলও (BLO) রয়েছেন। তিনি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বলেন, ৩১ ডিসেম্বর দুপুর ১২টার বৈঠকটি যেন লাইভ টেলিকাস্ট করা হয়, যাতে মানুষ সত্য জানতে পারে।
২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে এদিন তৃণমূলের নতুন প্রচার স্লোগান “যতই করো হামলা, আবার জিতবে বাংলা” এবং “মানবে না হার, তৃণমূল আবার”-এর আনুষ্ঠানিক প্রকাশ করেন অভিষেক। প্রধানমন্ত্রীর ‘বাঁচাতে চাই’ স্লোগানকে কটাক্ষ করে তিনি পাল্টা স্লোগান দেন— “বাঁচতে চাই, বিজেপি বাই”। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে মতুয়া ভোটব্যাঙ্ক এবং পরিযায়ী শ্রমিকদের হেনস্থা— প্রতিটি ইস্যুতেই বিজেপিকে কড়া ভাষায় আক্রমণ করেন তিনি।
তিনি বলেন, 'রাজ্যের বিরোধী দলনেতা ইউনূসকে সার্টিফিকেট দিয়েছিল। শুনলাম অমিত শাহ আসছেন। তাকে জিজ্ঞাসা করুন বাংলাদেশ দখল হবে কিনা। আমি নিজে অপারেশন সিঁদুরের হয়ে ডেলিগেশনে গিয়েছিলাম। অনেকে জানতে চান আমি কেন সংসদে অপারেশন সিঁদুর নিয়ে আলোচনায় অংশ নিন। আসলে আমি বলতে গিয়ে কেন্দ্রকে আক্রমণ করলে সেটা আন্তর্জাতিক মহলে ভুল বার্তা যেত। আমি সেটা চাইনি। আমার কাছে দেশ আগে। যে কেউ রাজনৈতিক দল করতেই পারে। জনতাকে বোকা ভাববেন না। জনতা সব বোঝে। লড়ে, জিতে আসুন। মন্দির, মসজিদ, গুরুদ্বার, চার্চ বানাতেই পারেন। রাজনৈতিক অবস্থান থেকে সরে গিয়ে করুন। এটা নিয়ে রাজনীতি করা শোভা পায় না'।
আগামী ২ জানুয়ারি থেকে অভিষেক নিজে রাস্তায় নামছেন। বারুইপুর থেকে শুরু করে উত্তরবঙ্গের চা বলয় পর্যন্ত পদযাত্রা ও জনসভার মাধ্যমে এই আন্দোলনের ঝাঁজ আরও বাড়ানো হবে বলে তিনি জানান। পরিশেষে তাঁর কড়া বার্তা, কমিশন যদি স্বচ্ছ তালিকা প্রকাশ না করে, তবে দিল্লিতে নির্বাচন কমিশনের দপ্তর ঘেরাও করতেও পিছুপা হবে না তৃণমূল কংগ্রেস।