সমৃদ্ধ দত্ত: পৃথিবীতে সবথেকে বেশি বাড়ছে ‘কনফ্লিক্ট জোন’। অর্থাৎ সংঘাতপূর্ণ রাষ্ট্র। প্যালেস্টাইন, সিরিয়া, লিবিয়া, লেবানন, ইয়েমেন, মায়ানমার, সুদান, কঙ্গো, সোমালিয়া, নাইজেরিয়া, মালি এবং হাইতি। কমবেশি বহু বছর ধরে এই দেশগুলিতে চলছে গৃহযুদ্ধ। স্থায়ী সরকার, স্থিতিশীল প্রশাসন আসছে না। ‘কনফ্লিক্ট জোনে’ সবথেকে দ্রুত যা হয়, সেটি হল ব্যবসা-বাণিজ্য, জীবিকা, সরকার, আইনশৃঙ্খলা সব ধীরে ধীরে উধাও হয়ে যায়। সে দেশে তখন জোর যার, মুলুক তার। অস্ত্র ব্যবসায়ীরা প্রবেশ করে। সেই সঙ্গে খাদ্যাভাব, মূল্যবৃদ্ধি এবং সন্ত্রাসবাদ। তিন বছর আগে এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে ইউক্রেন। অর্থাৎ এশিয়া-আফ্রিকার পর ইউরোপের একটি দেশও এখন ‘কনফ্লিক্ট জোন’।
২০২৫ সাল ভারতের ঠিক পাশে দু’টি নতুন ‘কনফ্লিক্ট জোন’ সৃষ্টি হওয়ার আভাস দিচ্ছে। নেপাল ও বাংলাদেশ। ২০২৪-এ বাংলাদেশ এবং ২০২৫ সালে নেপাল উত্তাল হয়েছে ‘জেন জি’ আন্দোলনে। একই প্যাটার্ন। একই পরিণতি। এবং দুই দেশই যেন জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি। মনে রাখতে হবে ‘কনফ্লিক্ট জোন’ যদি একবার তৈরি হয়ে যায়, তাহলে সেটি কিন্তু ১০-২০ বছরেও শান্ত হয় না। ফলে চরম বিপজ্জনক এক ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভারতের সামনে।
২০২৫ সাল ভারতকে উপহার দিয়েছে অন্তহীন সংঘাত। রাজনৈতিক সংঘাত প্রত্যাশিত। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকার তথা বিজেপি বনাম ইন্ডিয়া জোটের মধ্যে মতানৈক্য নতুন নয়। কিন্তু এই প্রথম গণতন্ত্রের সবথেকে বড়ো যে শক্তি ভারতের ছিল, সেই ভোটপ্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আমরা যে ভোট দিচ্ছি, সেটির ভিত্তিতেই সরকার তৈরি হচ্ছে তো? নির্বাচন কমিশনকে এত কোণঠাসা এবং সরকারের অংশ হয়ে যেতে ৭৯ বছরে কোনওদিন দেখা যায়নি। সুতরাং গণতন্ত্র রক্ষার একটি সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে, যা প্রদান করেছে ভোটের প্রতি সন্দেহ।
দু’টি নতুন সংঘাত ভারতের জন্য চরম উদ্বেগ সৃষ্টি করে দিয়েছে এবছর। প্রথমত বহু বছর পর আবার পূর্ণ শক্তি নিয়ে সন্ত্রাসবাদ ফিরে এসেছে। পহেলগাঁওতে জঙ্গিরা অবাধে এসে হামলা করেছে। বহু বছর পর কেন? পুলওয়ামায় তো ২০১৯ সালেই হামলা হয়েছিল। হ্যাঁ হয়েছিল। কিন্তু কাশ্মীরের উরি, পুলওয়ামা, পাঞ্জাবের পাঠানকোটে যে জঙ্গি হামলাগুলি হচ্ছিল, সেগুলির টার্গেট ছিল সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনী। ২০২৫ সালে সাধারণ নাগরিককে নিশানা করে হামলা করা শুরু হয়েছে। প্রথমে পহেলগাঁওয়ে এবং তারপর লালকেল্লার সামনে। সৃষ্টি হয়েছে হাড় হিম করা এক আতঙ্কের। কারণ, গোটা ভারতের মধ্যে একমাত্র এই দুই রাজ্যেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা সবথেকে কঠোর বলে জানা ছিল। দ্বিতীয় সংঘাত আন্তর্জাতিক, যার অভিঘাত দীর্ঘকালীন এবং সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। এই সংঘাত ১১ বছর পর নরেন্দ্র মোদি ‘মিথ’কে নাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছে। এত বছর ধরে সরকার এবং বিজেপি সযত্নে বহুমাত্রিক প্রচারে তাঁকে ‘বিশ্বগুরু’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু অপারেশন সিন্দুরের পর ভারত যখন অনেকটাই চেপে ধরেছে পাকিস্তানকে, ঠিক তখন আসরে অবতীর্ণ হলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এবং তিনি আচমকা ঘোষণা করে দিলেন যে, তিনিই দু’পক্ষকে ধমক দিয়ে যুদ্ধ বন্ধ করিয়েছেন। নিয়ম করে প্রতিদিন এই কথা বলে গেলেন তিনি। আর তারপর ভারতের উপর চাপিয়ে দিলেন ৫০ শতাংশ শুল্ক, যা বছর শেষ হয়ে গেলেও বলবৎ রয়েছে। ২০১৪ সালের পর থেকে ভারত যখন ক্রমেই রীতিমতো প্রকটভাবে আমেরিকা শিবিরের দিকে ঝুঁকেছে, তখন ট্রাম্পের এমন আচরণ রীতিমতো রহস্যজনক। ভারত নামক দেশের ভাবমূর্তি যথেষ্ট উজ্জ্বল ও শক্তিশালী। সেখানে দু’বারের এক মার্কিন প্রেসিডেন্ট সুকৌশলে গোটা ২০২৫ সাল জুড়ে মোদিকে ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্বল প্রতিপন্ন করার মরিয়া চেষ্টা করে গেলেন।
প্রধানমন্ত্রী এবং ভারত সরকার অবশ্য এবছরেই কুশলী এবং অত্যন্ত শক্তিশালী অবস্থান নিয়ে পালটা ট্রাম্পকে কঠোর বার্তা দিয়েছেন। সেটি হল, ভারত আবার পূর্ণাঙ্গভাবে রাশিয়ার হাত ধরেছে। রাশিয়ার সঙ্গে কোনওরকম সম্পর্ক রাখা যাবে না বলে আমেরিকা যত হুঁশিয়ারি দিয়েছে, ততই মোদি ও পুতিনের মধ্যে বন্ধুত্ব বেড়েছে। পুতিন দিল্লি সফরে এসে সেই মৈত্রীকে আরও শক্তিশালী করেছেন। আমেরিকাকে আরও চাপে ফেলে ভারত, রাশিয়া ও চীন, একটি নতুন অক্ষ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল হয়েছে। বছরের শেষে এসে এই সম্ভাবনায় রীতিমতো আতঙ্কিত আমেরিকা। একটি পেন্টাগন রিপোর্ট প্রকাশ করে তারা প্রমাণ করার চেষ্টা করছে যে, চীন কখনও ভারতের বন্ধু হতে পারে না। অরুণাচল প্রদেশ দখল করতে চায় বেজিং। সুতরাং ২০২৫ সাল ভারতের বিদেশনীতির নির্ধারণও সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ হতে চলেছে।
কেন? কারণ পাকিস্তানের সঙ্গে অঘোষিত যুদ্ধ চলাকালীন এবং যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পর আচমকাই দেখা গেল, ভারত আন্তর্জাতিক মহলে কিছুটা যেন একা হয়ে পড়েছে। রাশিয়া একমাত্র পাশে। কিন্তু যেভাবে তাবৎ পশ্চিমী রাষ্ট্র এক বছর আগেও ভারতকে বন্ধু, শক্তিশালী পার্টনার হিসেবে দেখে এসেছে, সেই আবহ হঠাৎ যেন দেখা যাচ্ছে না। কেন? একটি অভিমত হল, ভারত ভারসাম্য বজায় রাখার নামে কোনও স্পষ্ট অবস্থান নেয়নি। বিবদমান দুই গোষ্ঠীকেই তুষ্ট করতে গিয়ে গুরুত্ব হারিয়েছে। ভারত রাশিয়াতেও আছে, ইউক্রেনেও আছে। ইজরায়েলও ভালো, প্যালেস্টাইনও ভালো। ইরানও ভালো, ইজরায়েলও ভালো। আন্তর্জাতিক দুনিয়ার সমীকরণ সর্বদা এভাবে রসায়ন নির্মাণ করে না। নতুন দুনিয়া চাইছে, পক্ষ নাও। স্পষ্ট করে জানাও, কোনদিকে তুমি! সেই স্পষ্ট অবস্থান ভারত নেয়নি।
২০২৫ সালে দু’টি বিধানসভা নির্বাচন হয়েছে। দু’টি নির্বাচনেই বিজেপি জয়ী হয়েছে। কিন্তু বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল, রাজনীতির বাইরে থেকে আসা দুই ভিন্ন রাজনৈতিক ভাষ্যের আমদানি করা ব্যক্তিত্বের হেরে যাওয়া। দিল্লিতে অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবং বিহারে প্রশান্ত কিশোরের পরাজয়। এই দুই ফলাফলই যথেষ্ট বিস্ময়কর। কারণ, বর্তমানে যে ওয়েলফেয়ার পলিটিক্স মান্যতা পেয়েছে সব দলের কাছেই, সেই প্রবণতার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক কেজরিওয়াল। দিল্লিতে ক্ষমতাসীন হয়ে তিনিই প্রথম বিদ্যুৎ ফ্রি, জল ফ্রি, বাসে মহিলাদের যাত্রা ফ্রি এসব চালু করেছিলেন। তিনি উচ্চপদস্থ সরকারি আধিকারিক ছিলেন। রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে। আর সেই তাঁকেই জেলে যেতে হয়েছে দুর্নীতির মামলায়। পরাজিত হতে হয়েছে সেই ইস্যুতেই।
আবার গণতন্ত্রের মজাদার এক উদাহরণ হয়ে রয়ে যাবেন প্রশান্ত কিশোর। তিনি একের পর এক প্রথম সারির নেতানেত্রীর নির্বাচনি স্ট্র্যাটেজিস্ট হিসেবে কাজ করে ভোটে বিপুল সাফল্য পেয়েছেন। অথচ নিজেকে জেতাতে পারলেন না। বিহারে তিনি ব্যতিক্রমী বিকল্প রাজনীতি আমদানির প্রচার করেও প্রত্যাখ্যাত হলেন। অর্থাৎ ভারতের রাজনীতি একই ধারায় রয়ে গেল আপাতত। একদিকে বিজেপি ও সংঘপরিবার। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি। আর অন্যদিকে পরিবারতন্ত্রের রাজনৈতিক দল। তেজস্বী যাদব, অখিলেশ যাদব, রাহুল গান্ধী, এম কে স্ট্যালিনরা।
বছরের শেষে একটি অপ্রত্যাশিত আলোকরেখার উদয় ঘটেছে রাজনীতির আকাশে। কংগ্রেসের মুখ রাহুল গান্ধী। কিন্তু সর্বশেষ সংসদ অধিবেশনে দেখা গেল, তিনি ঠিক যতটা কঠোর ও অনমনীয় হয়ে মোদিকে টক্কর দিয়ে থাকেন, সেখানে প্রিয়াঙ্কা গান্ধী সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী এক রাজনীতির অ্যাপ্রোচের জন্ম দিয়েছেন। বন্দেমাতরম নিয়ে সংসদে তিনি বলার সময় বিজেপি, মোদি সকলকেই আক্রমণ করলেন বটে, কিন্তু হাসতে হাসতে, অত্যন্ত সৌজন্যসূচকভাবে। তাঁকে কটাক্ষ করা হলেও একগাল হেসে জবাব দিলেন। লোকসভার স্পিকারের ঘরে চা পানের আসরে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে হেসে হেসে কুশল বিনিময় করলেন। বিজেপি এমপি-মন্ত্রীদেরও দেখা গেল জনান্তিকে বলতে যে, প্রিয়াঙ্কা অনেক ম্যাচিওরড! এমনকী ইদানীং কংগ্রেসের অন্দরেও দাবি উঠছে, প্রিয়াঙ্কাকেই সামনে রাখা হোক। ২০২৫ সাল কি গান্ধী পরিবারের ভূমিকাবদলের ইঙ্গিত দিয়ে গেল?
২০২৫ সালে দুই রাজ্যে জয়ী হয়েছেন মোদি। কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক কেরিয়ারের শেষতম অগ্নিপরীক্ষা হতে চলেছে ২০২৬ সাল। তিনি যদি কেরল, অসম, তামিলনাড়ু, পুদুচেরিতে তর্কের খাতিরে জয়ী হয়ে যান, তাহলেও সেই সাফল্য তাঁকে শান্তি দেবে না। যদি না একটি রাজ্য দখল করতে পারেন, সেটি হল— বাংলা।
১১ বছরে পাঁচটি নির্বাচনে একটানা মোদিকে হারিয়ে চলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যাবতীয় পুরুষ রাজনীতিকদের পরাজিত করতে সক্ষম হচ্ছেন মোদি। এক ও একমাত্র অপরাজেয় প্রতিপক্ষ এক নারী। তৃণমূলনেত্রী। এখানে এসেই মোদির পরাজয় ঘটছে। সুতরাং ২০২৬ সাল মোদির কাছে ‘এবার নয় নেভার’!
২০২৫ সাল বাঙালির জন্য কী রেখে গেল? একরাশ দুশ্চিন্তা এবং অসম্মান। অনুপ্রবেশকারীর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হওয়ার প্রবণতায়, আদতে সবথেকে বেশি টার্গেট করা হচ্ছে বাঙালিকে। উত্তরপ্রদেশ থেকে তামিলনাড়ু। অসম থেকে ওড়িশা। বাংলাভাষী হলেই গণপিটুনি, বিতাড়ন, ঘরবাড়িতে আগুন এবং হত্যার ঘটনা এখন একটি নিত্যদিনের সংবাদে পরিণত হয়েছে। বাঙালি দরিদ্র ছিল, বাঙালি ধনী ছিল, বাঙালি উদ্বাস্তু ছিল, বাঙালি সংস্কৃতিমনস্ক ছিল, বাঙালি বিপ্লবী ছিল, বাঙালি শিক্ষিত ছিল, বাঙালি ভীরু ছিল, বাঙালি সাহসী ছিল। কিন্তু বাঙালি নিজভূমে পরবাসী ছিল না! ২০২৫ সাল বাংলা ভাষা, বাঙালি অস্তিত্বকেই চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে! বাংলা বললেই বাংলাদেশি! এই তকমার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে রাষ্ট্র কিন্তু কঠোরভাবে বাঙালির পাশে দাঁড়াচ্ছে না! বাঙালি কি পারবে এই সংকটের মোকাবিলা করতে?