সুমন ঘোষ, খড়্গপুর
সই মানে কী?
বানান অপরিবর্তিত রেখে সংসদ বাংলা অভিধান তিনটে অর্থ জানাচ্ছে— স্বাক্ষর, সখীর কথ্য রূপ ও যোগ্য। সইয়ের প্রথম অর্থ, অর্থাৎ স্বাক্ষর নিয়ে গল্প, সিনেমা, স্মৃতিচারণও বড় কম নেই। ছোট্ট মানিকের (সত্যজিৎ রায়) অটোগ্রাফের খাতায় গুরুদেব (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) শুধু সই–ই দেননি, লিখে দিয়েছিলেন আস্ত একটি কবিতা (‘বহু দিন ধ’রে বহু ক্রোশ দূরে/বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে...’)। সে গল্পও কম–বেশি সবার জানা। কিন্তু সই যে কখনও শত্রু হতে পারে, কেউ কি ভেবেছিলেন?
এ বঙ্গে ‘সার’ (স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন) শুরু হওয়ার পর থেকে ঘটনার ঘনঘটার কোনও বিরাম নেই। ‘সার’–সৌজন্যে নিত্যদিনই কোনও না কোনও ঘটনার কথা উঠে আসছে। বাবা–মায়ের উপরে গোঁসা করে সেই কবে হারিয়ে গিয়েছিলেন ছেলে। এনিউমারেশন ফর্ম পূরণ করতে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছেন। তেমনই, বন্ধুর বাবা কিংবা শ্বশুরমশাইকে নিজের বাবা পরিচয় দিয়ে ভোটার তালিকায় নামও তুলেছিলেন কেউ কেউ। ‘সার’–এর গুঁতোয় সে তথ্যও ফাঁস হয়ে গিয়েছে! ২০০২–এর ভোটার তালিকায় নাম নেই অনেকের। এমনই সব ‘কেস’ ধরে ধরে শুনানির নোটিস পাঠাতে হচ্ছে ইলেক্টোরাল রেজিস্ট্রেশন অফিসারদের (ইআরও)। আর সেই গুচ্ছ গুচ্ছ সই করতে গিয়ে তাঁদের অনেকেই বলছেন, ‘কাজের চাপ এই প্রথম নয়। কিন্তু পাতায়, পাতায় সই করতে গিয়ে মনে হচ্ছে সইয়ের আর এক নাম শত্রু!’
কথাটা কিন্তু নেহাত কথার কথা নয়। নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গিয়েছে, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ১৫টি বিধানসভা থেকে ৬৫ হাজারেরও বেশি মানুষকে শুনানিতে ডাকা হচ্ছে। অর্থাৎ, বিধানসভা পিছু গড় সংখ্যাটা দাঁড়াচ্ছে প্রায় সাড়ে চার হাজারের কাছে। এক জন ব্যক্তিকে ডাকতে দু’টি নোটিসে সই করতে হচ্ছে। একটি নোটিস যাবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে, অন্যটি থাকবে নির্বাচন কমিশনের কাছে।
ওই নোটিসে সই করতে পারবেন ইআরও বা অ্যাডিশনাল ইলেক্টোরাল রেজিস্ট্রেশন অফিসাররা (এইআরও)। যাঁদের কেউ বিডিও বা বিডিও অফিসের কোনও একটি বা দু’টি সেকশনের দায়িত্বে থাকা আধিকারিক। এমনিতেই তাঁদের দৈনিক বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের কাজে হাজারও ফাইলে সই করতে হয়। তা নিয়ে হিমশিম খেতে হয় বছরভর। এ বার তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘সার’–এর নোটিস। জেলার এক বিডিও বলছেন, ‘এই ক’দিনেই কত নোটিসে যে সই করেছি তার ইয়ত্তা নেই। তার বাইরেও নানা কাজ রয়েছে। শুনানির ভিডিয়ো, নথি আপলোড করা, কেন সংশ্লিষ্ট ভোটারের নাম চূড়ান্ত তালিকায় থাকবে বা কেন থাকবে না সে সবেরও ব্যাখ্যা লিখতে হচ্ছে।’
ওই বিডিও–র সংযোজন, ‘ছোটবেলায় ভাবতাম, বড় হয়ে সই করার সুযোগ পেলে অন্য ভাবে করব। লোকজন অন্তত দেখলে যেন বলে, এই হচ্ছে সই। বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তিদের সই খুঁটিয়ে দেখতাম। কিন্তু সত্যি কথা বলতে, এই ‘সার’ চক্করে সই ঘিরে যাবতীয় রোমান্টিকতা উধাও হয়ে গিয়েছে। বিশ্বাস করুন, এক সময়ের সাধের সইকে এখন শত্রু বলেই মনে হচ্ছে।’
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গিয়েছে, দাঁতন-২ ব্লকে ৭০০ ব্যক্তিকে শুনানিতে ডাকা হবে। কেশিয়াড়ি ব্লকে সংখ্যাটা আবার দেড় হাজারের কিছু বেশি। ডেবরা ব্লকে তিন হাজারেরও বেশি লোককে শুনানিতে ডাকা হচ্ছে। মেদিনীপুর ও খড়্গপুর বিধানসভায় সংখ্যাটা আরও বাড়বে বলেই মনে করা হচ্ছে। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক এইআরও বলছেন, ‘এত দিন শুনে এসেছি, ভোট বড় বালাই। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি ‘সার’ আরও বড় বালাই।’
অতএব, সই–ই সই। আর হাতে রইল পেনসিল, থুড়ি পেন!