• ল্যাবে নেই জরুরি সরঞ্জাম, নামেই প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস জেলার সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত স্কুলে!
    এই সময় | ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫
  • দিব্যেন্দু সরকার

    ঢাল নেই, তরোয়াল নেই, নিধিরাম সর্দার। জেলা ও মফস্সলের সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত স্কুলগুলোর অবস্থা অনেকটা সেরকমই।

    শিক্ষার প্রসার ঘটাতে ঢালাও ভাবে মাধ্যমিক স্কুলগুলিকে উচ্চ মাধ্যমিকে স্তরে উন্নীত করেছে রাজ্য সরকার। আর্টস, কমার্স, বিজ্ঞানের পাশাপাশি চালু হয়েছে অনেক নতুন বিভাগ। বহু স্কুলে একাদশ থেকে চালু করা হয়েছে কম্পিটার অ্যাপ্লিকেশন বিভাগ। এই সব বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতে গেলে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস জরুরি। তার জন্য দরকার হয় আধুনিক ল্যাবরেটরি ও যন্ত্রপাতি। কিন্তু অধিকাংশ স্কুলেই তার যথেষ্ট খামতি রয়েছে বলে জানাচ্ছেন বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং সাধারণ পড়ুয়ারা। অনেক স্কুলের প্রধান শিক্ষকরা জানাচ্ছেন, ল্যাবরেটরি থাকলেও মূলত টাকার অভাবে কেনা যাচ্ছে না প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস করার জন্য কেমিক্যালও জুটছে না। পর্যাপ্ত কম্পিডার না থাকায় পড়ুয়ারা সমস্যায় পড়ছে। স্কুলের লাইব্রেরির হালও তথৈবচ।

    হুগলির খানাকুলের রামনগর অতুল বিদ্যালয়ে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি মিলিয়ে বিজ্ঞান বিভাগে প্রায় ১৫০ জন পড়ুয়া রয়েছে। স্কুলে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও জীববিদ্যার ল্যাবরেটরি থাকলেও সাজ-সরঞ্জামের অভাব রয়েছে। বিজ্ঞান বিভাগের একাধিক পড়ুয়া জানিয়েছে, ল্যাবরেটরির যন্ত্রপাতি পুরোনো হয়ে যাওয়ায় সেগুলো দিয়ে এখন ঠিকমতো কাজ করা যায় না। পদার্থবিদ্যা ও রসায়নের প্র্যাকটিক্যালের জন্য যে সব জিনিসপত্র লাগে যেমন, নিকেল সালফেট, নিকেল ক্লোরাইড, কোবাল্ট নাইট্রেট, সিলভার নাইট্রেট, ট্রানজিস্টার সেট, ব্যারোমিটার ইত্যাদি যন্ত্রপাতি সময়ে পাওয়া যায় না। ফলে পড়ুয়ারা ঠিকভাবে প্র্যাকটিক্যাল করতে পারে না। ভূগোল বিভাগের আছে ৭৫ জন পড়ুয়া। তারাও ঠিকমতো প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস করার সুযোগ পায় না। কম্পিউটার বিভাগে মোট পড়ুয়ার সংখ্যা ১৪০ জন। কিন্তু কম্পিউটার আছে মাত্র ১০টা। স্কুলের প্রধান শিক্ষক অমিত আঢ্যের আক্ষেপ, 'দীর্ঘদিন হয়ে গেল ল্যাবরেটরির জন্য সরকার থেকে কোনও অনুদান মেলেনি। অথচ, যে সব স্কুলে বিজ্ঞান বিভাগে অত পড়ুয়া নেই, তারা ঠিক অনুদান পেয়ে যাচ্ছে!'

    আরামবাগের কেশবপুর মহেন্দ্র ইনস্টিটিউটশন বহু পুরোনো স্কুল। ২০২২ সালে ল্যাবরেটরির উন্নতির জন্য এই স্কুলকে সরকার থেকে মোট ২ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছিল। তারপর থেকে আর কোনও আর্থিক সাহায্য আসেনি। ফলে ল্যাবরেটরির অধিকাংশ যন্ত্রপাতি পুরোনো হয়ে গিয়েছে। স্কুলে কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন নিয়ে পড়ানো হয়। এই বিভাগের বর্তমানে ১৬ জন পড়ুয়া আছে। কিন্তু কম্পিউটার আছে মাত্র দুটো। সেটাও একজন প্রাক্তন ছাত্র দান করেছিলেন। স্কুলের প্রধান শিক্ষক রাজকুমার খামরুই বলেন, 'আরও অন্তত দু'-তিনটি কম্পিউটার পাওয়া গেলে চালিয়ে নেওয়া যেত। দু'টো কম্পিউটারে কাজ চালাতে খুবই সমস্যা হচ্ছে।'

    গোঘাটের বদনগঞ্জ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক নির্মলেন্দু সিংহ জানান, বিজ্ঞান শাখায় একাদশে ৮০ জন এবং দ্বাদশে ৭৫ জন পড়ুয়া থাকলেও সেই তুলনায় যন্ত্রপাতি কম। তাই দফায় দফায় প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস নিতে হয়।

    গোঘাটের কাঁঠালি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক অমলেশ লায়েক বলেন, '২০২১ সালে আমরা ২ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা অনুদান পেয়েছিলাম। তার মধ্যে ভূগোলের ল্যাবরেটরির জন্য ৪৫ হাজার দেওয়া হয়েছিল। তা দিয়ে খুব সামান্য কিছু জিনিসপত্র কেনা গিয়েছিল। ২০১৫ সালে কম্পিউটার বিভাগ চালু হয়েছে। তার জন্য স্কুল থেকে দু'টো কম্পিউটার কেনা হয়েছে। যদিও প্রয়োজনের তুলনায় সংখ্যাটা খুবই কম।

    মুথাডাঙা রামকৃষ্ণ উচ্চ বিদ্যালয়ের ভার প্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক (টিচার ইন চার্জ) রাজেন সিংহ রায় বলেন, 'আমাদের ল্যাবরেটরির অবস্থা মোটেও ভালো ছিল না। দিল্লির একটি সংস্থা ল্যাবটাকে মোটামুটি সাজিয়ে দিয়েছে। তাতেই আমাদের চলে যাচ্ছে।' স্কুল শিক্ষা দপ্তরের এডিআই নিলয়কান্তি ঘোষ বলেন, 'আমি মাস দুয়েক আগে আরামবাগ মহকুমায় এসেছি। এখনও পর্যন্ত স্কুলগুলো থেকে সেই রকম কোনও আবেদন আসেনি। আবেদন এলে সেগুলিকে নিয়ে বসে আলোচনা করে বিকাশ ভবনে পাঠিয়ে দেব।' শেওড়াফুলি সুরেন্দ্রনাথ হাইস্কুলে প্রায় দু'-হাজার পড়ুয়া রয়েছে। স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আলাদা ল্যাব রয়েছে। কিন্তু ল্যাবের সমস্ত যন্ত্রপাতি পুরোনো। অর্থাভাবে নতুন করে কোনও যন্ত্রপাতি কেনা সম্ভব হয়নি। প্রধান শিক্ষিকার কথায়,'আমাদের একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রদের জন্য যে ল্যাব রয়েছে, সেটা মোটের উপরে ঠিকঠাকই রয়েছে। কিন্তু ছাত্রীদের ল্যাবের অবস্থা ততটা ভালো নয়। সেটা মান্ধাতার আমলের। তার সংস্কারের প্রয়োজন আছে।'

    বেলুড় পঞ্চাননতলা মহেন্দ্র বিদ্যাপীঠে লাইব্রেরি থাকলেও কোনও লাইব্রেরিয়ান নেই। সরকারি অনুদান না মেলায় শিক্ষকদের ব্যক্তিগত সংগ্রহের বই দিয়েই কোনও মতে লাইব্রেরি চলছে। লাইব্রেরির দেখাশোনা করেন ইংরেজির এক শিক্ষক। বলা ভালো, তাঁরই ব্যক্তিগত উদ্যোগে কোনও মতে লাইব্রেরিটা চালু রয়েছে। পাঠ্যপুস্তক ও রেফারেন্স বই ছাড়াও এখানে ইংরেজি ও বাংলা গল্পের বই ও সাধারণ জ্ঞানের বই মজুত রয়েছে।

    বালি শিক্ষা নিকেতন স্কুলেও লাইব্রেরিয়ানের পদ খালি। তাই শিক্ষকরাই লাইব্রেরির দেখভাল করেন। এক শিক্ষক জানান, কয়েক বছর আগে একবারই বই কেনার অনুদান মিলেছিল। তখন বেশকিছু বই কেনা হয়েছিল লাইব্রেরির জন্য। তারপর থেকে আর নতুন করে লাইব্রেরির জন্য কোনও বই কেনা হয়নি।

  • Link to this news (এই সময়)