স্কুলের মোটা গাঁথনির ঠান্ডা, স্যাঁতসেঁতে পরিবেশের মধ্যেও ঘামছেন মহিলা। মাঝেমধ্যেই কাপড়ে মুখ মুছছেন। গলা নামিয়ে ফোনে বলছেন, ‘‘আমাদের নামগুলো বোধহয় বাদই চলে যাবে! কাকে কী বলব? সকাল থেকে দাঁড়িয়ে আছি, শুনছেন কে?’’ প্রবল উৎকণ্ঠা মহিলার গলায়। ফোনে কথা শেষ করেই হাল ছেড়ে দেওয়ার মতো করে মহিলা পাশের ব্যক্তিকে বললেন, ‘‘কী হবে রে ভাই! বাবা কেন পদবিটা বদলাতে গিয়েছিল বল তো! আমরা নাকি ভোটার নই? যে দেশে জন্মেছি, সে দেশে এখন প্রমাণ চাওয়া হচ্ছে!’’ প্রবল বিরক্ত নিয়ে পাশের ব্যক্তি বললেন, ‘‘নাম বাদ যায় যাক, এই চাপ আর নেওয়া যাচ্ছে না।’’
ভবানীপুরের মিত্র ইনস্টিটিউশন স্কুল চত্বরের এই দৃশ্যের মতো এমন বহু উৎকণ্ঠার ছবিই শনিবার এসআইআর শুনানি শুরুর দিনে চোখে পড়ল শহরের নানা কেন্দ্রে। উত্তর এবং দক্ষিণ মিলিয়ে কলকাতার ১১টি বিধানসভার প্রায় ১২১টি টেবিলে এ দিন শুনানি হয়েছে বলে নির্বাচন কমিশন সূত্রের খবর। প্রায় ৩২ লক্ষ ভোটার, যাঁরা ২০০২ সালের তালিকার সঙ্গে যোগসূত্র দেখাতে পারেননি, শুনানির এই পর্বে তাঁদেরই ডাকা হচ্ছে। সেই জন্যই কেউ কাজে ছুটি নিয়ে সকাল থেকে লাইনে এসে দাঁড়িয়েছেন, কেউ এসেছেন অসুস্থ-অশক্ত শরীরে। কেউ এসেছেন হুইলচেয়ার বা অ্যাম্বুল্যান্সেও!
নির্বাচন কমিশন অসুস্থ, প্রবীণ বা বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে ভোটারের বাড়িতে গিয়ে শুনানি করা হবে বলে জানালেও, সেই তথ্য ভোটারদের কাছে পৌঁছেছে কিনা, এ দিনের বহু দৃশ্য সেই প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে। অনেকে আবার বলছেন, তাঁদের কেন ডাকা হয়েছে, সেটাই বুঝে উঠতে পারছেন না। নথি দেখানোর পরেও সমস্যার সুরাহা কী ভাবে, বোঝা যাচ্ছে না বলেও দাবি অনেকের। তাঁদেরই এক জনের দাবি, ‘‘আর কত বার কত কারণে লাইন দিতে হবে কে জানে! এ দিনও বলা হল, নথি মিলছে না।’’ মধ্য কলকাতার একটি কেন্দ্রের সামনে আর এক ভোটার আবার বললেন, ‘‘এ দিনও সমস্যা মিটল না। কেন ডাকা হয়েছিল, সেটাই কেউ বুঝতে পারছেন না।’’
মিত্র ইনস্টিটিউশনে হাজির এক সত্তরোর্ধ্বের যেমন দাবি, ‘‘কিউআর কোডে ভুল থাকায় ডাকা হয়েছে আমাকে। আমার ফর্মের কিউআর কোডে অন্য লোকের নাম আসছে। এতে তো আমার গাফিলতি নেই, তা হলে আমাকে কেন এই বয়সে ছুটতে হবে?’’ সেখানেই হাজির শীলা মাইতি নামে এক মহিলা আবার জানালেন, তাঁর বাবা সুধাংশুশেখর মাইতি নিজের পদবি বদল করেছিলেন। কিন্তু ভোটার তালিকায় আগের পদবিই রয়ে গিয়েছে। পরে নতুন পদবি দিয়েই তাঁদের ভাই-বোনেদের ভোটার কার্ড-সহ সমস্ত নথি তৈরি করিয়েছিলেন বাবা। এখন পদবি না মেলায় নাম বাদ যেতে বসেছে। মহিলা বললেন, ‘‘সকাল থেকে লাইন দিয়ে আছি। কী করে প্রমাণ করা যাবে, এখনও বুঝে উঠতে পারিনি।’’
মোমিনপুরের একটি কেন্দ্রের বাইরে আবার দেখা গেল, টেবিল পেতে ‘হেল্পডেস্ক’ খোলা হয়েছে একটি রাজনৈতিক দলের তরফে। শুনানি কেন্দ্র ঘুরে সেখানে হাজির এক ভোটার বললেন, ‘‘নথি যা আছে, সেই অনুযায়ী ফর্ম পূরণ করেছিলাম। এখন শুনানিতে ডেকে বলা হয়েছে, ভুল তথ্য দেওয়ার জন্য আইনি পদক্ষেপ করা হতে পারে। আতঙ্কে আছি।’’ একই রকম দাবি বন্দর এলাকার হরিমোহন ঘোষ কলেজে হাজির এক ভোটারের। তিনি বললেন, ‘‘২০০২ সালের তালিকায় নাম ছিল আমার। সমস্ত নিয়ম মেনেই ফর্ম পূরণ করেছি। এখন বলা হচ্ছে, তথ্য মিলছে না।’’
ফুলবাগানের একটি স্কুলের কেন্দ্রে আবার অ্যাম্বুল্যান্সে হাজির হয়েছিলেন ৭৩ বছরের স্বপ্না ঘোষ। তাঁর দাবি, প্রবীণদের জন্য আলাদা বন্দোবস্ত রয়েছে জানানোর পরেও তিনি এসেছেন। তাঁর দাবি, ‘‘কষ্ট হলেও চলে এসেছি। এ জিনিস ফেলে রাখতে চাই না।’’ দিনভর ঘুরে চোখে পড়ল, এ দিন শুনানির জন্য ডাকা না হলেও অনেকেই চলে এসেছেন সমস্যা নিয়ে। অভিযোগ, তাঁদের নিয়ে আলাদা করে বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে কমিশনের প্রতিনিধিদের। এক কেন্দ্রের অ্যাডিশনাল ইলেক্টোরাল রেজিস্ট্রেশন অফিসার (এইআরও) বললেন, ‘‘এমন বহু লোকও চলে আসছেন, যাঁদের এ দিন ডাকাই হয়নি। তাঁদের কেউ এসে বলছেন, শনিবার ছুটি, তাই চলে এসেছি, কেউ বলছেন, প্রথম দিনেই কাজ সারতে এসে পড়েছেন।’’
উত্তর কলকাতার একটি কেন্দ্রের শুনানি টেবিল থেকে বেরোনো মহিলার অবশ্য ইতিবাচক মন্তব্য, ‘‘খুব জটিল কিছু নয়। প্রথম শুনানিতেই সংশয় মিটে গিয়েছে।’’