• শীত পড়তেই বেড়াতে আসছে মানুষ, পর্যটনের হাত ধরে চাঙ্গা বেলপাহাড়ির মরশুমি অর্থনীতি
    এই সময় | ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫
  • বুদ্ধদেব বেরা, বেলপাহাড়ি

    জঙ্গলের মাঝে ফাঁকা জায়গায় বস্তা বিছিয়ে মৌসুমি লেবু বিক্রি করছিল দুই খুদে। ঘাঘরা, খাঁদারানিতে পৌঁছতে চোখে পড়ল ত্রিপল খাটিয়ে বসেছে চা, পকোড়ার দোকান। কেউ খোলা আকাশের নীচেই পাথরের থালা-বাটির পসরা সাজিয়েছে। আরেক জায়গায় দেখা গেল ট্রাইবাল ফুডের ছড়াছড়ি। শাল চিকেন, বাম্বু চিকেনের পাশাপাশি দেদার বিক্রি লাল পিঁপড়ে কুরকুটের চাটনির। দেখা গেল চাউমিন, এগরোলের স্বাদ বদলাতে পর্যটকদের অনেকেই ভিড় করেছেন ওই সব খাবারের দোকানে। মুখে হাসি বিক্রেতাদেরও। কারণ এ সব খাবারের জন্য মূলত স্থানীয়রাই ভিড় করত। ইদানীং পর্যটকেরাও এ সব খেতে পছন্দ করায় আয় বেড়েছে তাদের

    শুধু খাবার নয়, জঙ্গলমহলের বিভিন্ন হস্তশিল্পের (বাবুই ঘাসের তৈরি ঘর সাজানোর জিনিস, পাথরের থালা-বাটি) প্রতিও পর্যটকদের আগ্রহ হাসি ফুটিয়েছে শিল্পীদের মুখে। ফলে পর্যটন মরশুমে চাঙ্গা স্থানীয় অর্থনীতি। পর্যটকদের কল্যাণে দৈনিক ভালো রোজগার করছেন বিক্রেতারা। পর্যটন মরশুমে জঙ্গলমহলে গ্রামবাসীদের এমন লক্ষ্মী লাভে জেলার অর্থনীতিতে আশার আলো দেখছেন অনেকে। সেবাভারতী মহাবিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক নান্টু পাল বলেন, 'পর্যটন এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে স্থানীয় মানুষের রুটি-রুজিও জড়িত। তাই পর্যটক বেশি এলে স্থানীয়দের হাতে বাড়তি টাকা আসে। স্থানীয় অর্থনীতিও চাঙ্গা হয়।'

    এ বছর বড়দিন থেকেই হাউসফুল ঝাড়গ্রাম। বেলপাহাড়ির ঘাগরা, খাঁদারানি লেক, গাড়রাসিনি পাহাড়, লালজল, ঢাঙ্গিকুসুম ও কাঁকড়াঝোড়ে উপচে পড়ছে পর্যটক। পর্যটকদের চাহিদা মেটাতে গ্রামের রাস্তার দু'পাশে ও পর্যটন স্থলে রকমারি পসরা সাজিয়ে বসেছেন গ্রামবাসীরা। বেড়ানোর পাশাপাশি দেদার কেনাকাটায় ব্যস্ত পর্যটকরা। খাঁদারানি যাওয়ার পথে বারিঘাটি গ্রামে মৌসুমি লেবুর পসরা সাজিয়ে বসেছিল একদল খুদে। তাদেরই একজন জয়জীবন হাঁসদা বলে, 'ঘরের কাছে গাছে অনেক মৌসুমি লেবু ধইরছে। তাই বিকতে আনছি। বাবুদের অনেকেই কিনছে। তাই রোজ লেবু আনছি।' খাঁদারানিতেই পাঁচ বছর ধরে চায়ের দোকান চালান ভারতী মুন্ডা। তিনি বলেন, 'ত্রিপল ঘেরা দিয়ে চায়ের দোকান খুলেছিলাম। আজ পাকার করেছি। সারা বছর লোক এলেও এই সময় যেন মেলা লেগেছে। প্রতিদিন ভালোই বিক্রি হচ্ছে।' পাথরের থালা, বাটি নিয়ে বসেছিলেন পাথরশিল্পী নব মিস্ত্রি। তাঁর কথায়, 'এখানকার পাথরের তৈরি জিনিস পর্যটকেরা খুব পছন্দ করছেন। কিনছেনও। কয়েক দিন ধরে বিক্রিও ভালো হচ্ছে।' ঘাগরায় দেখা গেল শাল চিকেন, বাম্বু চিকেন ও কুরকুটের চাটনিতে মজে পর্যটকেরা। বাঁশের খুটি-ত্রিপলের ছাউনির ঘেরাটোপে ট্রাইবাল ফুডের স্বাদ নিতে ভিড় করেছেন তাঁরা। দোকানদার শুকলাল মান্ডি বলেন, 'সারা বছর চাষের কাজ করি। শুধু এই কটা দিন এখানে খাবারের দোকান দিই। আগে বেড়াতে আসা লোকজন এ সব খাবারের দিকে তেমন পা বাড়াত না। চাউমিন, এগরোলের দোকানে ভিড় করত। এখন এ সব খাবারের টানে ভিড় করছেন অনেকে। অনেকে কুরকুটের চাটনি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। বিক্রিও বেশ ভালো।'

    তবে নব মিস্ত্রি থেকে শুকলাল মান্ডি-সকলের আক্ষেপ, প্রশাসনের উদ্যোগে যদি এই সব জায়গায় পাকা স্টল করে দিত এবং সেই সঙ্গে শুধু শীতে নয়, বর্ষাতেও পর্যটনকে জনপ্রিয় করতে ব্যবস্থা নিত, তা হলে পর্যটন ঘিরে এলাকার মানুষের আয় বাড়ত। কারণ বর্ষায় জঙ্গলমবলের অন্যরূপ। বেলপাহাড়ির গাড়রাসিনি পাহাড় সংলগ্ন এক হোম-স্টের মালিক শঙ্কর সিং বলেন, 'দিনের পর দিন পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে বেলপাহাড়িতে। দুটো ঘর থেকে হোম-স্টে শুরু করেছিলাম। এখন দশটি হয়েছে। সবকটিরই বুকিং রয়েছে। গ্রামের বেশ কয়েকজন যুবকও কাজ করে আমার হোম-স্টেতে। তাই পর্যটনে প্রশাসন গুরুত্ব দিলে এলাকার মানুষের আরও র্কমসংস্থানের পাশাপাশি অথনীতিও চাঙ্গা হবে।'

  • Link to this news (এই সময়)