কাজের জন্য বাইরে থাকায় শুনানিতে অনুপস্থিত বহু, জেলায় নাম বাদের আশঙ্কা অনেকের
বর্তমান | ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫
নিজস্ব প্রতিনিধি কৃষ্ণনগর: শীতের কুয়াশা ঘেরা সকাল। কৃষ্ণনগর–১ নম্বর বিডিও অফিসে উপচে পড়া ভিড়। ভীমপুর, পোড়াগাছা, ভাণ্ডারখোলা, দিগনগর সহ বিভিন্ন পঞ্চায়েত এলাকা থেকে বাসিন্দারা নথিপত্রভর্তি ব্যাগ হাতে লাইনে দাঁড়িয়ে। কেউ কেউ সঙ্গে এনেছেন ছোট শিশুদেরও। অফিস চত্বরে গাছের তলায়, মেঝেতে ও বেঞ্চে বসে বয়স্করা। দীর্ঘদিন ভোট দিলেও ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় নাম নেই। ডাক পড়েছে শুনানিতে। তাই ঠাণ্ডা উপেক্ষা করেই সকাল সকাল হাজির হয়েছেন সবাই। লক্ষ্য একটাই কমিশনের কাছে নতুন করে প্রমাণ করতে হবে নাগরিকত্ব।
সোমবার ছিল সপ্তাহের প্রথম দিন। ব্লক অফিস চত্বরে চূড়ান্ত ব্যস্ততা। কমিশনের চোখে ‘সন্দেহজনক ভোটাররা’ মাটিতে বসে নথিপত্র ঠিক রয়েছে কি না মিলিয়ে নিচ্ছেন। যেন জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষায় বসতে চলেছেন তাঁরা! ইটলার অসিত ঘোষের পরিবারও শেষ মুহূর্তে ঝালিয়ে নিচ্ছিলেন নথিপত্র। ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় স্ত্রী’র স্বামীর জায়গায় অসিতের নাম থাকলেও নিজের নাম নেই। তিনি বলেন, ‘অনেক আগে কাকাদের সঙ্গে এদেশে এসেছি। রেশন, আধার ও ভোটার কার্ড থাকলেও অন্য কোনও নথি নেই। ছেলের জন্ম শংসাপত্র ও অ্যাডমিট কার্ডে আমার নাম রয়েছে। সেগুলিই জমা দিয়েছি।’
অনেকের হাতে আবার রয়েছে ১৯৭১ ও ১৯৮১ সালের ভোটার তালিকা। তবে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে নাম মুছে গিয়েছে। ব্লক অফিসের ভিড়ে দাঁড়িয়ে এক মাঝবয়সি ব্যক্তি ক্ষোভের সুরে বলেন, ‘দেশ ছেড়ে এসে এখানেও নতুন জ্বালা।’ লাইনে দাঁড়ানো বাসিন্দাদের, বিশেষ করে বয়স্কদের চোখেমুখে আতঙ্ক। অফিসের চত্বরে গাছের তলায় বসে এক সত্তরোর্ধ্বের বৃদ্ধা বলছিলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে বহু কষ্টে এদেশে এসেছি। তখন কোনও কাগজ ছিল না। এখন শুধু কাগজ চাইছে। আমার কারণে যাতে পরিবারের কোনও ক্ষতি না হয়, তাই লাইনে দাঁড়িয়েছি।’ ২০০০ সালের বন্যায় কাগজপত্র হারিয়ে শুনানিতে এসে কার্যত মাথায় হাত বৃদ্ধা ইমলি রাজভরতের।
তবে, সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন যাঁরা ভিনরাজ্য কিংবা বিদেশে কাজ করেন। শুনানির ডাক পেলেও দ্রুত ফ্লাইট ও ট্রেনের টিকিট বুক করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। তাঁদের নাম বাদ পড়া এক প্রকার নিশ্চিত বলেই মনে করছেন প্রশাসনের আধিকারিকরা। হাতে গরম উদাহরণ অনেক। যেমন, ভীমপুরের অশীতিপর বৃদ্ধা বাদল অধিকারীর ছেলে। ঠান্ডার মধ্যে ব্লক অফিস চত্বরে মাটিতেই বসেছিলেন বৃদ্ধা। ছেলে মালদ্বীপে কাজ করেন। পাসপোর্ট থাকলেও শুনানিতে হাজিরা দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। বৃদ্ধার বউমা উদ্বেগের সুরে বলছিলেন, ‘আমার স্বামী তো আসতে পারবে না মালদ্বীপ থেকে। অল্প সময়ের মধ্যে এত টাকা দিয়ে টিকিট কেটে আসা সম্ভব নয়।’ নথিপত্র না থাকায় সমস্যা পড়েছেন বাদলদেবীও। মুক্তিযুদ্ধের আগেই বাংলাদেশ থেকে এদেশে এসে নথিপত্রের ব্যবস্থা না করেই স্বামীর মৃত্যু হয়। যদিও ১৯৭১ ও ১৯৮১ সালের ভোটার তালিকায় তাঁর নাম রয়েছে, সেটাই এখন বৈধ ভোটার হওয়ার একমাত্র প্রমাণ। বিক্রি করা জমির দলিল কমিশনের কাছে কার্যকর নয়। বৃদ্ধার কথায়, ‘ছেলের পাসপোর্টে আমার নাম রয়েছে। আর কোনও কাগজ নেই। আগে ভোট দিয়েছি। কিন্তু ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় নাম নেই।’
কমিশন সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রথম দিনে ৫ হাজার ৩২১ জনকে শুনানিতে ডাকা হলেও হাজির হন ৪ হাজার ৫২১ জন। দ্বিতীয় দিনে ২ হাজার ১৭১ জন ডাকা হলেও উপস্থিত ছিলেন ১ হাজার ৮৩৩ জন। সোমবার নদীয়া জেলাজুড়ে ১৬ হাজার ১১৯ জনের শুনানি হওয়ার কথা। বাইরে কাজের কারণে বহু ভোটার অনুপস্থিত। শুনানি চলছে কৃষ্ণনগর বিডিও অফিসে। -নিজস্ব চিত্র