কলহার মুখোপাধ্যায়, কলকাতা: এক সাহেবের অনুরোধে, সব সাহেবের জন্য এক সাহেব আঁকলেন ‘দ্য লাস্ট সাপার’। ভিঞ্চির আঁকা যিশুর শেষ ভোজসভার বিখ্যাত শিল্পকর্মটির মতো কিন্তু স্বতন্ত্র একটি ছবি। আঁকা হল শহরে বসে। লালমুখো ব্রিটিশরা একদিন দেশ ছেড়ে চলে গেল। কিন্তু সঙ্গে নিয়ে যেতে পারল না তাঁদের গর্বের বিখ্যাত শিল্পকর্মটি। সেটি হয়ে গেল নেটিভদের। ফলে মালিক হয়ে গেল কলকাতা। সেটি এঁকেছিলেন প্রখ্যাত শিল্পী, ব্রিটিশ রয়্যাল অ্যাকাডেমির সদস্য ‘যোহান জোফানি’। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির বিশ্ববিখ্যাত লাস্ট সাপারের পরতে পরতে লুকিয়ে রহস্য, রয়েছে একাধিক ইঙ্গিত। আর জোফানির লাস্ট সাপার ঘিরে লুকিয়ে বিতর্ক, সমালোচনা, অনাদর, নষ্ট করে দেওয়ার চেষ্টার হাজার কাহিনি।
ছবিটি আছে সেন্ট জনস চার্চে। অর্থাৎ বিবাদী বাগে, হাইকোর্টে ঢোকার গলিতে। দেখতে দেখতে সেটির বয়স ২৫০ বছর হয়ে গেল। এখনও তার উজ্জ্বল রং। এখনও দর্শকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। বিদেশের বহু পর্যটক কলকাতায় এলে ছবিটি দেখতে চার্চে যান।
জানা যায়, এক নিলামওয়ালার থেকে টাকা ধার নিয়ে ফেরত দিচ্ছিলেন না জোফানি। জোর করে তা আদায় করেন নিলামওয়ালা। সেই রাগে জোফানি করলেন কি, যিশুর সঙ্গী বিশ্বাসঘাতক জুডাসের মুখটা করে দিলেন নিলামওয়ালার মতো। তা গির্জায় টাঙানোর পর বিস্তর হাসাহাসি শুরু হল। নিলামওয়ালা রেগে আগুন। তিনি কলকাতার এক মান্যগণ্য ব্যক্তি। ফলে শুরু প্রতিবাদ। প্রবল বিতর্ক। তৎকালীন পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেট কোমল মুখশ্রীর এক পুরুষ ছিলেন। তিনি মহিলাদের ছদ্মবেশ ধারণ করতেন আর অপরাধী ধরতেন। তাঁকে মেয়েলি চেহারার সেন্ট জনের আদলে আঁকলেন জোফানি। যিশুকে আঁকলেন শহরের এক পাদ্রীর মতো করে। দেখার পর শহরজুড়ে সমালোচনার ঝড়। জোফানির সঙ্গে নেহাত সরকারের উপরমহলের ভালো যোগাযোগ ছিল তাই কোনওরকমে সে যাত্রা রক্ষা পেয়ে গেলেন। না হলে মামলা, মোকদ্দমা, জেল, জরিমানা আরও অনেক কিছুই হতে পারত বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন।
ভিঞ্চির লাস্ট সাপার রয়েছে মিলানে সান্তা মারিয়া গির্জায়। ছবিটির মধ্যে তিনি বহু রহস্যজনক সূত্র ছেড়ে রেখে গিয়েছিলেন। যা নিয়ে এখনও গবেষণা চলে। ‘দ্য ডা ভিঞ্চি কোড’ নামে হয়েছে টম হ্যাঙ্কসের বিখ্যাত সিনেমা। আর কলকাতার লাস্ট সাপারের সর্বাঙ্গে বিতর্ক, কলোনিয়াল সময়ের ইতিহাস, ভারতীয় ও ইউরোপীয় শিল্পকলার সেতুবন্ধন এবং অনাদর জড়িয়ে। জানা গিয়েছে, ইংরেজ আমলে ছবিটি নষ্ট করে ফেলার চক্রান্ত হয়েছিল। এছাড়াও বারবার অনাদরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেটি। সে কথা গির্জার বিবরণীতে লেখাও হয়েছিল। শেষপর্যন্ত দু’শতাব্দী বাদে ২০১০ সালে ঠিকমতো সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়। এখন ফের চকচক করছে বিখ্যাত লাস্ট সাপার।
সেন্ট জনস চার্চে সারাবছরই লোকজন আসে। ১০ টাকার টিকিট কেটে ঢুকলে আড়াইশো বছর আগের কলকাতার খণ্ডাংশ যেন আচমকা চলে আসে চোখের সামনে। চার্চ চত্বর ফাঁকা ফাঁকা। বিস্তীর্ণ। উন্মুক্ত। এখানেই জোব চার্নকের সমাধি রয়েছে। আর চার্চের ভিতর টাঙানো দ্য লাস্ট সাপার। কলকাতায় পা রাখার পর জার্মান শিল্পী জোফানি ওয়ারেন হেস্টিংসের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। তাঁর ছবি আঁকেন। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এলাইজা ইম্পে সহ রাজ পরিবারের বহু সদস্যের ছবি আঁকেন। এভাবে ইংরেজ সরকারের কাছাকাছি এসেছিলেন। হেস্টিংসই তাঁকে একটি অল্টারপিস আঁকতে বলেছিলেন। তারপরই জন্ম লাস্ট সাপারের। ১৭৮৭ সালের ৯ এপ্রিল চার্চকে ছবিটি উপহার দেন জোফানি। জুন মাসে টাঙানো হয়।
ছবিটি চার্চের স্থাপত্য, ধর্মীয় ব্যবহার ও প্রার্থনার অঙ্গ ছিল। ফলে ধর্মীয় সম্পত্তি। আর চার্চ আইন (একলেসিয়াসটিকাল ল) মোতাবেক তা অন্যত্র নিয়ে যাওয়া সহজ ছিল না। তাই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বা ব্রিটিশ প্রশাসন সরাসরি এটিকে রাজকীয় সম্পত্তি বলে দাগিয়ে ইংল্যান্ডে নিয়ে যেতে পারেনি। কলকাতাতেই থেকে যায় বিখ্যাত লাস্ট সাপার। এবং এই শহর হয়ে ওঠে তার আসল মালিক। কলকাতার অলিগলিতে যে অসংখ্য ইতিহাস লুকিয়ে থাকে। সহজে দেখা দেয় না। লাস্ট সাপার সেরকমই একটি ভুলে যাওয়া গল্প। হঠাৎ মনে পড়ে। আর দেখার জন্য চঞ্চল হয় মন।