পাটশিল্পের কফিনে পেরেক, কেন্দ্রের দাক্ষিণ্যে লাভবান সেই ‘প্লাস্টিক লবি’
বর্তমান | ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫
দেবাঞ্জন দাস ও সঞ্জয় গঙ্গোপাধ্যায়: কলকাতা ও বারাকপুর: কাঁচাপাট সরবরাহে সংকটের জেরে রাজ্যের চটশিল্প ভয়াবহ সমস্যার সম্মুখীন। চলতি বছরের জুন মাসে স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ থেকে কাঁচাপাট এবং পাটজাতসামগ্রী আমদানি নিষিদ্ধ হওয়ার জেরেই এই সংকট বলে ইন্ডিয়ান জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন (আইজেএমএ) সূত্রের খবর। কাঁচামালের সংকটের জেরে গত ১০ দিনে শুধুমাত্র বারাকপুর শিল্পাঞ্চলেই বন্ধ হয়েছে পরপর তিনটি জুটমিল। বাংলার এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পের সংকট পর্বেই কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের ‘অবস্থান’ সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলেছে। আগামী জানুয়ারি মাস পর্যন্ত প্রায় ১২ লক্ষ গাট চট ব্যাগের অর্ডার দিয়েছিল কেন্দ্র সরকার। আইজেএমএ সূত্রের খবর, সেই অর্ডার বাতিল করে তা দেওয়া হয়েছে প্লাস্টিক লবিকে। তাতে সংকট ঘোরতর আকার ধারণ করেছে। প্রসঙ্গত, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের জুটমিলের জন্য যে কাঁচা পাটের প্রয়োজন পড়ে, তার ৯৮ শতাংশ স্থলপথে পেট্রাপোল সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশ থেকে আসত। আমদানি নিষেধাজ্ঞায় বিশেষ করে সংকটে পড়েছে বাংলা, যেখানে গোটা দেশের পাটজাত সামগ্রীর ৮২ শতাংশ তৈরি হয়।
আইজেএমএ সূত্রে জানা গিয়েছে, গত জুন মাসের ওই নিষেধাজ্ঞার সঙ্গেই ‘অদ্ভুত’ একটি শর্ত আরোপ করে কেন্দ্র সরকার। তা হল, স্থলবন্দরে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও, সমুদ্রপথে কাঁচাপাট আমদানি করা যাবে। তবে তা করতে হবে মহারাষ্ট্রের নবি মুম্বইয়ের ‘নবসেবা’ সমুদ্র বন্দর দিয়েই। এই শর্তে মহারাষ্ট্র সহ পশ্চিম ভারতের জুট লবি লাভবান হলেও, দেশের সর্বোচ্চ জুট সামগ্রী প্রস্তুতকারক রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিহার, অসমের চটকলগুলিও। পাটশিল্প নিয়ে সৃষ্ট এই সংকট দূরীকরণে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ দাবি করে গত ১১ ডিসেম্বর ডাইরেক্টর অব ফরেন ট্রেডস অজয় ভাদুকে চিঠি লিখেছেন আইজেএমএ’র চেয়ারম্যান রাঘবেন্দ্র গুপ্তা। আমদানি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছিলেন আইজেএমএ চেয়ারম্যান। তাঁর কথায়, বাংলাদেশ থেকে আমদানি বন্ধ হয়েছে, এটা ঠিক। এছাড়া আমাদের এখানে উৎপাদনও কম হয়েছে। সবমিলিয়ে কাঁচামালের অভাবে ধুঁকছে রাজ্যের জুটমিলগুলি। তার মধ্যেই জুট ব্যাগের অর্ডার কমিয়ে দিয়েছে কেন্দ্র সরকার। রবি মরশুমের জন্য আগামী জানুয়ারি মাস পর্যন্ত যত জুট ব্যাগের অর্ডার ছিল, তার মধ্যে ১১ লক্ষ ৯০ হাজার গাঁটের বরাত বাতিল করা হয়েছে।
এই পর্বেই কেন্দ্রীয় বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রকের পরিসংখ্যান কাঁচামালের সামগ্রিক সংকটকে তুলে ধরেছে। মন্ত্রকের পরিসংখ্যান বলছে, গত ২০২৪-২৫ সালে বাংলাদেশ থেকে ১ লক্ষ ১২ হাজার ৩৬ মেট্রিক টন পাট আমদানি করা হয়েছিল। যার আর্থিক মূল্য ছিল ৬৭১. ৬৯ কোটি টাকা। চলতি অর্থ বছরের (২০২৫-২৬) গত সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত মেলা পরিসংখ্যান বলছে, আমদানির পরিমাণ কমে হয়েছে ৩৯ হাজার ৩৭৭ মেট্রিক টন। যার আর্থিক মূল্য ২৭৯.৩১ কোটি টাকা। মন্ত্রক সূত্রে আরও জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান ভারত বিরোধী জিগির প্রভাব ফেলেছে বাণিজ্য ক্ষেত্রেও। অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বরেও পাট আমদানির পরিমাণ হতাশজনক। পেট্রাপোলের কাস্টমস ক্লিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গিয়েছে, আমদানি নিষেধাজ্ঞার দিন দুয়েক আগে পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে পণ্যবাহী যে ট্রাকগুলি ভারতে ঢুকত, তার ৬০ শতাংশই ছিল পাট ও পাটজাত সামগ্রীর। এখন তা ‘জিরো’ শতাংশে পৌঁছেছে।