দেশের হয়ে জোড়া স্বর্ণপদক জয় আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায়, দৌড়বিদ আতর আলিকে শুনানিতে ডাক!
বর্তমান | ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫
দীপন ঘোষাল, রানাঘাট: দৌড়ের ট্র্যাকে যিনি বারবার দেশের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন, সেই মানুষও এসআইআরের কোপে! নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণের তাগিদে তাঁকে দাঁড়াতে হচ্ছে শুনানির লাইনে। রানাঘাটের আতর আলি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় ভারতের হয়ে একাধিকবার পদক নিয়ে এসেছেন। সেই মানুষটিকেই কি না দাঁড়াতে হচ্ছে নাগরিকত্ব যাচাইয়ের শুনানির লাইনে। এই দুই বৈপরীত্বের সংঘাতে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এই ক্রীড়াবিদ। যা এসআইআর প্রক্রিয়া নিয়েই প্রশ্ন তুলে দেয়।
রানাঘাটের আনুলিয়া পঞ্চায়েতের শ্রীনাথপুরের বাসিন্দা আতর। জীবনের শুরু থেকেই সংগ্রাম তাঁর সঙ্গী। জন্মের আগেই বাবাকে হারানো ছিল প্রথম ধাক্কা। সময় লাগেনি দ্বিতীয় ধাক্কা আসতেও। বয়স যখন মাত্র পাঁচ, তখন ইহলোক ত্যাগ করেন মাও। এখানেই থেমে যেতে পারত আতরের জীবন। কিন্তু আতর থামেননি। দিদি রহিমা খাতুনের তত্ত্বাবধানে বেড়ে ওঠেন তিনি। লড়াই ছিল চূড়ান্ত অভাবের সঙ্গেও। সংসারের প্রতিকূলতার পাশাপাশি ছোটবেলা থেকেই আতরের ছিল শারীরিক প্রতিবন্ধকতা। তাকে সঙ্গী করেই লড়াই করেছেন। জন্মগত ভাবে ৫২ শতাংশ প্রতিবন্ধী, ডান পায়ের হাঁটু ও আঙুলে স্থায়ী সমস্যা, তবুও দৌড়ের প্রতি তাঁর টান এক মুহূর্তের জন্যও কমেনি। মাত্র ৫ ফুট ২ ইঞ্চি উচ্চতার এই যুবক মাঠেই খুঁজে পেয়েছেন নিজের জীবনের মানে। রাজ্য ও জাতীয়স্তরে একাধিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে তিনি যেমন বাংলার প্রতিনিধিত্ব করেছেন, তেমনই দেশেরও প্রতিনিধিত্ব করেছেন। উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, গুজরাত, দিল্লি, ছত্তিশগড় সহ দেশের নানা প্রান্তে ট্র্যাকে নিজের কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। ক্রীড়াক্ষেত্রে তাঁর এই নিরলস লড়াইয়ের সরকারি স্বীকৃতিও মিলেছে। ২০২০ সালে তৎকালীন রাজ্যপালের হাত থেকে ‘রোল মডেল’ পুরস্কার, তার পরের বছর রাজ্য সরকারের ‘খেল সম্মান’। মুখ্যমন্ত্রীর স্বীকৃতিও পেয়েছেন তিনি। চলতি বছর সেই সাফল্যের তালিকায় যুক্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। নেপালে অনুষ্ঠিত ইন্দো-নেপাল যুব স্পোর্টস চ্যাম্পিয়নশিপে ২০০ ও ৪০০ মিটার দৌড়ে জোড়া সোনা জিতে ভারতের মুখ উজ্জ্বল করেছেন আতর। ‘নীতি আয়োগ’ স্বীকৃত এই প্রতিযোগিতায় দক্ষিণ এশিয়া সহ বিশ্বের ২২টি দেশের প্রতিযোগীদের পিছনে ফেলে তিনি পৌঁছেছেন শীর্ষে।
কিন্তু সাফল্যের সেই আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। সম্প্রতি এসআইআর প্রক্রিয়ায় তাঁকে নাগরিকত্ব সংক্রান্ত শুনানিতে হাজির হতে বলা হয়, যা পদক জয়ের আনন্দকে মুহূর্তে নিরানন্দে পরিণত করেছে। যে মানুষটি দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে দৌড়েছেন, তাঁরই ভারতীয়ত্ব আজ প্রশ্নের মুখে! প্রশ্ন উঠবে বৈকি। চরম বেদনা বুকে নিয়ে তাঁর বক্তব্য, বড় আঘাত লেগেছে সম্মানে। দেশের পতাকা নিয়ে যেখানে আমি সমগ্র ভারতবর্ষের নাম উজ্জ্বল করতে চেয়েছি, সেখানে আমাকে প্রশ্ন করা হচ্ছে আমি ভারতীয় কি না! এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রশ্ন উঠছে ক্রীড়ামহলে ও স্থানীয় সমাজেও। দেশের হয়ে পদকজয়ী, শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী এক ক্রীড়াবিদকে এভাবে নাগরিকত্ব যাচাইয়ের লাইনে দাঁড় করানো কি মানবিকতার অপমান নয়! আতর আলির জীবনে আজ লড়াই শুধু দৌড়ের ট্র্যাকে সীমাবদ্ধ নয়। নিজের নাগরিক পরিচয়, আত্মসম্মান আদায় করতেও তাঁকে ছুটতে হচ্ছে সমান তালে। নথি হাতে আতর আলি। নিজস্ব চিত্র