• বসন্ত চৌধুরী-চিন্ময় রায়ের নায়িকা, যাত্রাশিল্পী মল্লিকার মাস চলে অনুদানের ২ হাজার টাকায়
    বর্তমান | ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫
  • সত্যজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, বারুইপুর: একসময় লোকে অটোগ্রাফ নিতে ছুটত। ৩০-৪০ বছর আগের সে কাগজ এখন স্বাভাবিকভাবেই মলিন। শুনলে আশ্চর্য লাগে, তখন যিনি অকাতরে অটোগ্রাফ বিলোতেন সেই নায়িকার জীবনটা এখন অটোগ্রাফের কাগজগুলোর থেকেও মলিন। গ্রামগঞ্জ কাঁপাতো যে যাত্রাপালা, যে গান সুপার ডুপার হিট হতো, সে পালার নায়িকা চলে গেলেন বিস্মৃতির অতলে। সে গানের গায়িকা চলে গেলেন সম্পূর্ণ অন্তরালে। রইল একরাশ অভিমান আর টালির চালের একটি একচিলতে বাড়ি আর কয়েকটি বই। সেগুলি নিয়েই থাকছেন এককালের দশদিক কাঁপানো নায়িকা। কেউ মনে রাখল না বলে কিছু অবহেলা, কিছু বিস্মৃতি নিয়ে দিনরাত বইয়ের পাতা উল্টোন মল্লিকা চট্টোপাধ্যায় দত্ত। তাঁর জীবনের পাতাও উল্টোতে উল্টোতে ৭০ বছরে এসে গেল। বৃদ্ধা মানুষটির সঙ্গে কেউ দেখাও করতে আসে না। 

    শুনতে আশ্চর্য লাগে কারণ, এক সময়ের দিকপাল অভিনেতা চিন্ময় রায়, বসন্ত চৌধুরীর নায়িকা হয়ে যাত্রামঞ্চ কাঁপিয়েছিলেন মল্লিকাদেবী। বাংলা এবং অসমীয়া ভাষায় গান গাইতেন। তাঁর নাম তোলপাড় করে দিত সাংস্কৃতিক জগত। ‘গাজী মস্তান’, ‘নিশিপুরের বৌ’, ‘বড়োনিয়া বধূ’ পালা সুপার হিট হয়েছিল। বাংলার সর্বত্র আর ত্রিপুরা, মণিপুর, অসম, ঝাড়খণ্ড যাত্রা করতে প্রায় ডেলি প্যাসেঞ্জারি করতেন। সেই মল্লিকাদেবী এখন একা হাঁটতে পারেন না। অসুস্থ। বই পড়ে কাটে সময়। রাজ্য সরকারের থেকে ২৫ হাজার টাকা বছরে অনুদান পান। জীবন চালাতে মাসে ওই দু’হাজার টাকাই যা ভরসা।

    বাবার অসুস্থতার কারণে বাড়িতে অভাব তাই ক্লাস থ্রি’র পর পড়াশোনা ছেড়ে ১৩ বছর বয়সে যাত্রায় অভিনয় শুরু। তারপর সংসারের জোয়াল টেনেই গিয়েছেন। বিয়ে হয়, দু’হাতে রোজগার করেছেন কিন্তু দারিদ্র কমেনি। টালির চালের বাড়ি কোনওদিনই পাকা হয়নি। বারুইপুর রামনগর দু’নম্বর পঞ্চায়েতের রামকৃষ্ণপল্লিতে সে বাড়ি। সেখানে মল্লিকার সময় কাটানোর সঙ্গী বলতে কিছু বই। 

    শীতের বিকেল নামে। উঠোনে গাছের ফাঁক দিয়ে চিলতে রোদ অস্পষ্ট মুখটিকে মৃদু স্পষ্ট করে। তখন মুখ খোলেন এককালের দিকপাল নায়িকা। জানা যায়, মন্মথ মজুমদারের কাছে যাত্রায় হাতেখড়ির পর নট্ট কোম্পানি, নিউ প্রভাস অপেরা, আর্য কোম্পানি, জোৎস্না অপেরার হয়ে অভিনয় করেছেন। বসন্ত চৌধুরী তারিফ করেছেন অভিনয়ের। গীতা দে’র সঙ্গে কারাগার নাটকে নেমে চূড়ান্ত সুখ্যাতি। বিখ্যাত যাত্রাশিল্পী স্বপনকুমার, দীপেন চট্টোপাধ্যায়, পান্না চক্রবর্তী, অসীম সরকার, বিমল লাহিড়ী, অমিয় বোস, শম্ভু বন্দ্যোপাধ্যায়দের বিপরীতে মঞ্চে নেমে মাতিয়ে দিয়েছেন দিনের পর দিন। 

    উঠোনের মৃদু রোদ্দুরের থেকেও নরম গলায় বলেন, ‘এখনকার অনেকে যেমন কাকলি, অনল আমার নাম জানে। ওঁরা যাত্রাশিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। তবে আমি কেমন আছি কেউ আর খোঁজ নেয় না।’ বলতে বলতে বাড়ির ভাঙাচোরা দশা নিয়েও আক্ষেপ বেরিয়ে আসে। বলেন, ‘আবাস যোজনায় নতুন বাড়ির জন্য বলেছিলাম পঞ্চায়েত সদস্যকে। কিন্তু পেলাম না।’ তাঁর ছেলে মলয় ডিটিপি অপারেটর। তিনি বলেন, ‘কেউই খোঁজ নেন না। মায়ের খুব ইচ্ছা, দিদি নম্বর ওয়ান শো’তে যাওয়ার। কেউ একটু ব্যবস্থা করে দেবেন?’

    ‘মন, মন কেন এত কথা বলে...’ মল্লিকাদেবীর গাওয়া একটি বিখ্যাত গান। কার গান না জেনে সেটি এখনও অনেকে গান। তাতে হাজার হাজার লাইক। শুধু গানটির শিল্পীর কথা কেউ জানতে চান না। বহু কথা জমে রয়েছে মল্লিকার। মন সব বলতে চায়। তবে শোনার কেউ নেই। কোনও এক বৃদ্ধ রেডিও বোধহয় জানে কিছু। শীতের দুপুরে সে গুনগুন করে, ‘মোর করুণ বল্লিকা/ও তোর শ্রান্ত মল্লিকা/ঝরো ঝরো হল, এই বেলা তোর শেষ কথা দিস বলি...।’
  • Link to this news (বর্তমান)