• বিশ্বায়নের মঞ্চে দুর্গাপুজোকে পৌঁছে দেওয়ার চার কারিগর
    বর্তমান | ০২ অক্টোবর ২০২২
  • সৌম্য নিয়োগী, কলকাতা: বাড়ির ঠাকুরদালান থেকে বারোয়ারি। বারোয়ারি থেকে থিম। আর সেই থিমের ম্যাজিকেই ইউনেস্কোর স্বীকৃতি। বাঙালির সর্বজনীন প্রাণের উৎসব এখন আক্ষরিক অর্থে বিশ্বজনীন। শুরুটা হয়েছিল সেই ১৯৯৮ সালে। তখন দেশে উদারনীতির পালে হাওয়া লাগেনি। কিংবা গোটা কলকাতার তাক লেগে যায়নি ভাঁড়ের প্যান্ডেল দেখে। সামান্য মজুরিতে আর্ট কলেজের এক ছাত্র হাত লাগালেন উত্তর কলকাতার হাতিবাগান সর্বজনীনের দুর্গাপুজোয়। ‘গণেশজননী’— প্রতিমার বিবর্তনের ইতিহাসে এক মাহেন্দ্রক্ষণ। এর দু’বছর বাদেই দুর্গাপুজোর দরবারে আত্মপ্রকাশ আরও এক জাতশিল্পীর। থিমমেকার বললেই আম জনতার মুখে উঠে আসে তাঁদের নাম, সনাতন দিন্দা এবং ভবতোষ সুতার। এবার শুধু ইউনেস্কো নয়, এই শহরকে বিশ্ব সংস্কৃতির স্পর্শে রাঙাতে উঠেপড়ে লেগেছেন এই দু’জন। এখানেই শেষ নয়। বলতে হবে আরও দু’জনের কথা — সুশান্ত পাল ও অনির্বাণ দাস।

    চলতি বছর দুর্গাপুজোর থিমশিল্পী হিসেবে ২৫ বছর পূর্ণ হচ্ছে সনাতনের। রজত জয়ন্তীতে তিনি বিস্ময় জাগাচ্ছেন এমন একজন মানুষের সৃষ্টিকে তিলোত্তমায় হাজির করে, যাঁকে সারা বিশ্ব চেনে। ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ। পোস্ট-ইমপ্রেশনিস্ট ঘরানার শিল্পীর প্রবাদপ্রতিম সৃষ্টি ‘দ্য স্টারি নাইট’ নেমে এসেছে ভবানীপুরের বকুলবাগানে। সঙ্গী কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আকাশভরা সূর্য তারা, বিশ্বভরা প্রাণ’ গান। এই নামেই এবার বকুলবাগানের থিম। গোটা পাড়াই এখানে ত্রিমাত্রিক ক্যানভাস। দেবীর শাকম্ভরী রূপেও তার ছোঁয়া। বাদ পড়েনি ভ্যান গঘের ‘আইকনিক’ সূর্যমুখী ফুল। সঙ্গে কানে বাজছে ‘বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান’। বেঠোভেনের সিম্ফনি, এমনকী রাগ চারুকেশীও শোনা যাচ্ছে মণ্ডপে। শিল্পী বলছেন, ‘২৫ বছরে এসে প্রথাগত চিন্তা থেকে সরে এসে আন্তর্জাতিক মানের কিছু করতে চেয়েছিলাম দুর্গাপুজোয়। কয়েক বছর ধরেই ভ্যান গঘের ছবি নিয়ে কাজ করার করার কথা ভেবেছি। তবে প্রয়োজন ছিল উপযুক্ত জায়গার। তাই এবার করেই ফেললাম।’ 

    চেনা ছকের বাইরে শিল্পী ভবতোষ সুতারের এবারের থিম চমকে দিয়েছে খোদ ইউনেস্কোর টিমকেও। তাঁর হাত ধরে চলতি বছর অর্জুনপুর আমরা সবাই ক্লাবের দুর্গাপুজো আর শুধু দেখার নয়, অভিজ্ঞতা অর্জনের। মণ্ডপজুড়ে যৌথ জীবন্ত উপস্থাপনা, ইংরেজিতে যাকে বলে পারফর্মিং আর্ট। দর্শক যেখানে নিছক পুজোপ্রেমী নন, একজন অংশগ্রহণকারী। বাড়ির ছাদ থেকে প্যান্ডেলের ভিতরে-বাইরে নিরন্তর চলছে ১০-১২ মিনিটের দৃশ্য, আলো, ধ্বনি এবং গান। দেবী নিজেকে পাশে রেখে ঢাকিদের জায়গা করে দিয়েছেন মায়ের মমতায়। থিমের নাম ‘স্বকাল’। ভবতোষ জানালেন, ‘প্রথমে এই নামটাও ছিল না। পরে একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে ‘স্বকাল’ এল। এটাকেই বোধহয় শিল্প বলে, যা আগে থেকে ভেবে রাখা যায় না। কলকাতার দুর্গাপুজো এর আগে কখনও এভাবে উপস্থাপিত হয়নি। আমি একটা পারফর্মিং স্পেস বানিয়েছি। প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের একটি গানের সঙ্গে মোট ৭০ জন এখানে জীবনকে চেনাবেন।’ ইউনেস্কোর প্রতিনিধিরা এবার চমকে গিয়েছেন আরও এক শিল্পীর কাজে। সুশান্ত পাল। টালা প্রত্যয়ের দুর্গাপুজোয় এবার তাঁর থিম ঋতি। গতবার তিনি কাজ করেছিলেন ‘নির্বাধ’ থিম নিয়ে। এবারের প্রেক্ষিত আরও বড়, মানব শক্তির উদযাপন। সুশান্তবাবুই বলছিলেন, ‘মহালয়ার আগে পুজোর কাজ প্রায় শেষ। ইউনেস্কো ডেলিগেট, বিদেশি পর্যটক, শিল্পের সমঝদাররা পুজো দেখছে প্রিভিউ শোয়ের মতো করে। এটা এই প্রথম। কলকাতার পুজোর বিবর্তিত রূপটা বিশ্বের দরবারে পৌঁছে যাওয়ার শুভ সূচনা হল।’

    দমদম পার্ক ভারতচক্রের থিমশিল্পী অনির্বাণ দাস গতবার চমকে দিয়েছিলেন কৃষক আন্দোলনের খণ্ডচিত্রকে তুলে এনে। এবারের থিম অন্তর্লীন। সেই থিমের পিছনে ছিল এক অদ্ভুত ঘটনা। শিল্পী অনির্বাণই শোনালেন সেকথা। বললেন, একদিন রাতে ঘুম আসছিল না। গান শুনতে ইচ্ছে করল। রবীন্দ্রসঙ্গীত... ‘আপনারে দিয়ে রচিলি রে কি এ আপনারই আবরণ! খুলে দেখ্‌ দ্বার, অন্তরে তার আনন্দনিকেতন।’ তখনই মনে হচ্ছিল, নিজেকে নিয়ে নিজেই এমন জাল বুনে রেখেছি যে হাঁসফাঁস করছি। ডিপ্রেশনের ওষুধ খেতে হচ্ছে দু’বছর ধরে। তখনই ভাবলাম নিজের সমস্যা নিয়ে যদি একটা কাজ করি। খুঁজতে খুঁজতে পেলাম লালনেরই একটা গান... ‘আমি আমি করে বেড়াই আমার মাঝে আমি কে তার খবর রাখি না।’ এটাকেই আবহ করে ভারতচক্রের কাজ করি।’ তবে গোটা বিশ্বের সমস্যাও তাঁর থিম থেকে দূরে থাকেনি। পূর্বাচল শক্তি সঙ্ঘে তিন কাজ করেছেন দূষণ, ভূমিধসের বিরোধী বার্তা নিয়ে। 
  • Link to this news (বর্তমান)